অগ্রবর্তী উদ্যানচাষী সমাজে সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, অগ্রবর্তী উদ্যানচাষী সমাজে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, অগ্রবর্তী উদ্যানচাষী সমাজে পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানবসমাজের বিবর্তনের ধারায় যেসব পর্যায়ের অবতারণা ঘটেছে সামাজিক ইতিহাস অনুধ্যানে সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে উদ্যানচাষী সমাজের আবির্ভাব ঘটে। উদ্যানচাষি সমাজ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকগণ গবেষণা পরিচালনা করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
১. সরল উদ্যানচাষী সমাজের বৈশিষ্ট্য : সরল উদ্যানচাষি সমাজ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যথা :
ক. স্বল্প হাতিয়ার : এ সমাজে মানুষ উন্নত ও বহুল পরিমাণে হাতিয়ার ব্যবহার করতে পারে নি। হাতিয়ার তৈরির কৌশল তারা তখনও আবিষ্কার করতে পারে নি হায়
খ. অধিক উৎপাদনশীল : সরল উদ্যানচাষি সমাজ শিকার ও সংগ্রহ সমাজ থেকে বেশি বড় এবং কম সমতাভিত্তিক। এটা ছিল অধিক উৎপাদনশীল ।
গ. লোকসংখ্যা : শিকার ও সংগ্রহ সমাজে যেখানে ৫০জন বা তার চেয়ে সামান্য বেশি মানুষ বসবাস করত সেখানে সরল উদ্যানচাষি সমাজে একশ থেকে দু’শ মানুষ বসবাস করত।
ঘ. উৎপাদিত খাদ্যের ভোগ : শিকার ও সংগ্রহ সমাজের মানুষ যেখানে একজন নেতার কর্তৃত্ব মেনে নিত সেখানে।সরল উদ্যানচাষি সমাজে একজন নেতার কর্তৃত্ব কতকগুলো সমাজে একই সাথে ‘বর্তমান ছিল। এ সমাজের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করা হতো।
ঙ. উদ্বৃত্ত ও উৎসব : সরল উদ্যানচাষি সমাজে স্বল্প পরিমাণে হলেও উদ্বৃত্ত ছিল। ফলে সমাজে অবকাশ যাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অবকাশে মানুষ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠত। এসব আনন্দ উৎসব ছিল জীবনকেন্দ্রিক। তারা কখনও কখনও ঘরবাড়ি নির্মাণে আত্মনিয়োগ করত ।
চ. যুদ্ধবিগ্রহ : সরল উদ্যানচাষি সমাজের মানুষের জীবন শান্তিপূর্ণ ছিল না। সমাজে প্রায় সর্বদা যুদ্ধ লেগে থাকত। Jivaro Indianদের মধ্যে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। যুদ্ধে বন্দিদেরকে নির্যাতন করা হতো। বন্দিদের সাথে অত্যাচার করে তারা আনন্দে মেতে উঠত।
ছ. যাযাবর জীবন : সরল উদ্যানচাষি সমাজে মানুষ ছিল যাযাবর। তবে স্বল্প সংখ্যক হলেও অনেকে স্থায়ী জীবন গড়ে তুলেছিল । Iroquisরা একই স্থানে ১০-১২ বছর বসবাস করত।
জ. ধর্ম : সরল উদ্যানচাষি সমাজের মানুষ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। জুনি সমাজে ধর্মীয় পাদ্রীদের উদ্ভব ঘটে। তারা খাদ্য সংগ্রহ বা উৎপাদনে অংশগ্রহণ করত না।
ঝ. নেতৃত্ব প্রদান : সরল উদ্যানচাষি সমাজে নেতৃত্ব প্রদান ও পূর্ণ সময়ব্যাপী কাজে পরিণত হয়। Headman বা প্রধানদের অধীনে সহকারী Headman নিযুক্ত হতো। দক্ষিণ আমেরিকার Trumai Indianদের মধ্যে একজন প্রধানদের দু’জন করে সহকারী থাকত, যারা প্রধানদের অনুপস্থিতিতে প্রধানের ভূমিকায় কাজ করত।
ঞ. বিভিন্নমুখী প্রতিভার বিকাশ : মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকে। ইরোকুয়া সমাজে যেসব বৃদ্ধ ও অন্য ব্যক্তি শিকার ও যুদ্ধে অংশ নিতে পারত না, তারা যুদ্ধাস্ত্র ও শিকার যন্ত্র তৈরি করত। এ সময় উদ্যানচাষি সমাজের অধিবাসীরা বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র, দ্রব্যসামগ্রীসহ অতিরিক্ত জিনিসপত্র তৈরি করত। ফলে সে সময় স্বল্প পরিসরে হলেও বাণিজ্যের প্রচলন শুরু হয়।
২. অগ্রবর্তী উদ্যানচাষি সমাজ : নৃবিজ্ঞানীদের অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর পূর্বে অগ্রবর্তী উন্নত উদ্যানচাষি সমাজের আবির্ভাব ঘটে। এরপর সমগ্র ইউরোপ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং সাহারায় উদ্যান কৃষি বিকাশ লাভ করে। তবে সর্বক্ষেত্রে এ সমাজের বৈশিষ্ট্য একইরূপ ছিল না। এর
কতকগুলো বৈশিষ্ট্য নিতে আলোচনা করা হলো :
ক. হাতিয়ার : সরল উদ্যানচাষি সমাজের হাতিয়ার ছিল যেখানে পাথরের তৈরি Digging stick, Hoe এবং Rake, সেখানে অগ্রবর্তী উদ্যানচাষি সমাজে এসে বিভিন্ন ডিজাইনের Metal hoe ব্যবহৃত হতে থাকে । নৃবিজ্ঞানী Forde বলেছেন, “Metal hoeগুলো Digging stick এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ও কর্মক্ষম ছিল।” ব্রোঞ্জ ও লোহা আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে
মানুষ কুঠার, চাকু, ছুরির ব্যবহার শেখে।
খ. খাদ্য সরবরাহ : অগ্রবর্তী উদ্যানচাষি সমাজে মানুষের দক্ষতা ও উৎকর্ষতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মানুষ হাতিয়ারকে উন্নত ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে নিশ্চয়তা দেখা দেয় ।
গ. উন্নত প্রযুক্তি : অগ্রবর্তী উদ্যানচাষি সমাজে মানুষ উন্নত প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে থাকে। তারা খাল খননের মাধ্যমে জমিতে জল সেচের ব্যবস্থা করে। পেরুর অগ্রবর্তী উদ্যানচাষি সমাজ পাহাড় কেটে সমতল ভূমি তৈরি করে ফসল ফলাত ।
ঘ. বৈপ্লবিক পরিবর্তন : মানুষ অল্প কয়েকদিন শ্রম দিলেই তার পরিবারের ভরণপোষণের বিষয় নিশ্চিত হয়ে যেত। এতে সমাজের সর্বত্র বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে ।
ঙ. জনসংখ্যা বৃদ্ধি : এ সমাজে জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরল উদ্যানচাষি সমাজের তুলনায় এখানে প্রায় চারগুণ জনসংখ্যার বসবাস লক্ষ্য করা যায়।
চ. সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : এ সমাজে এসে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হয়। উন্নত প্রযুক্তি, উদ্বৃত্ত ফসল, অবকাশ যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় । যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রতিপত্তি খাটানোর চেষ্টা থেকেই সাম্রাজ্য গড়ে উঠে।
ছ. অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা : অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সাম্রাজ্যের অনেক এলাকা থেকেই রাজস্ব আদায় করা সম্ভব ছিল না। ফলে রাজারা তাদের নিয়ন্ত্রণ সর্বত্র সমানভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি 1
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, উদ্যানচাষি সমাজ ছিল শিকার ও সংগ্রহ সমাজের অনুরূপ। কৃষি সমাজ থেকেই আধুনিকতার পর্ব শুরু হয়। সেদিক বিচারে কৃষি সমাজের পূর্ববর্তী সকল সমাজকে একই পর্যায়ে ফেলা যায়। উদ্যানচাষি সমাজ শিকার ও সংগ্রহ সমাজ থেকে কতকগুলো অংশে অগ্রসর ও স্বতন্ত্র ছিল ।