Other

শিল্প মনোবিজ্ঞান মৌলিক না ফলিত যুক্তিসহ উত্তর দাও ।

শিল্প মনোবিজ্ঞান মৌলিক না ফলিত যুক্তিসহ উত্তর দাও । অথবা,ফলিত মনোবিজ্ঞান হিসেবে শিল্প মনোবিজ্ঞানের স্থান নির্দেশ কর।
উত্তর:

ভূমিকা : আজকাল মনোবিজ্ঞানে বিজ্ঞানীরা শুধু জীব বা মানুষের আচরণ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেই বসে নেই, মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক শাখার উদ্ভব করে [ মানুষের প্রত্যকটি ক্ষেত্রের আচরণে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। যেমন- চিকিৎসা ক্ষেত্রে, শিল্পক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং খেলাধুলার ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। মনোবিজ্ঞানে হাতেকলমে | শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণের যে উন্নতি সাধন করে, তাই হলো ফলিত মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের প্রত্যকটি শাখারই ফলিত বা ব্যবহারিক দিক রয়েছে। শিল্প মনোবিজ্ঞান সেরকম একটি শাখা।

ফলিত মনোবিজ্ঞান হিসেবে শিল্প মনোবিজ্ঞান : শিল্প মনোবিজ্ঞান আসলে ফলিত মনোবিজ্ঞান কি না তা নির্ণয় করতে হলে এ দুইটি বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা দরকার। এ কারণে ফলিত মনোবিজ্ঞান এবং শিল্প মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ফলিত মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের যে শাখা মানুষের দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে, তাকে ফলিত বা ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক মনোবিজ্ঞান বলা হয়। কারণ মনোবিজ্ঞানের এ শাখা হাতেকলমে তৎক্ষণাত সমস্যার সমাধান করে থাকে। ফলিত মনোবিজ্ঞান সমস্যা সমাধানের। কাজ করে। মানুষের ব্যবহারিক কল্যাণে মনোবিজ্ঞানকে যথার্থভাবে প্রয়োগ করার জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি ও কৌশল সৃষ্টি। করার ফলিত মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। এ শাখা মনোবিজ্ঞানের সকল তত্ত্বীয় জ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষের প্রাতাহিক জীবনের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালায়। প্রত্যেক ফলিত মনোবিজ্ঞানীই মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে বাস্তব এবং মৌলিক জ্ঞান লাভ করেন এবং অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োগ করে থাকেন। ফলিত মনোবিজ্ঞানী মানুষের নানা প্রকার সমস্যা সমাধানের জন্য মনোবিজ্ঞানের মূলনীতিগুলো ব্যবহার করেন। আরও সাধারণভাবে বলা যায়, ফলিত মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণলব্ধ তথ্য, তত্ত্ব এবং মনোবৈজ্ঞানিক মূলনীতিসমূহকে প্রয়োগ করে মানুষের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালায়। তাই বর্তমানে ফলিত মনোবিজ্ঞানের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়।

শিল্প মনোবিজ্ঞান: শিল্প মনোবিজ্ঞান মূলত ফলিত মনোবিজ্ঞানের একটি তাৎপর্যপূর্ণ শাখা। এ শাখা শিল্প সংক্রান্ত নানা প্রকার সমস্যা সমাধানে এবং সঠিক উপায় নিরুপণে মনোবিজ্ঞানের সাধারণ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে থাকে। শিল্প মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের সেই শাখা, যেখানে শিল্পে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের আচরণ নিয়ে আলোচনা এবং এসব আচরণ শিল্পে কর্মরত ব্যক্তিদের উৎপাদনের ব্যাপারে কি ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে। শিল্পকে সাধারণভাবে পণ্য ও সেবা উৎপাদনের যন্ত্র বা কৌশল হিসেবেই গণ্য করা হয়। কিন্তু শিল্প মনোবিজ্ঞানে শিল্পের পরিসর বা পরিসি আরও ব্যাপকতর। শিল্প বলতে এখানে সকল প্রকার উৎপাদন, বণ্টন এবং ভোগের কার্যাবলি পর্যন্ত প্রসারিত।

শিল্প মনোবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য : শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য সহায়তা করা এবং উৎপাদনের পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় দিকেরই সমৃদ্ধি সাধন করা। শিল্পকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে কর্মচারীদের দক্ষতা, মনোবল, মনোভাব, কর্মসম্বন্ধি গভীরভাবে জড়িত বলে তাদের দক্ষতা ও মনোবল বৃদ্ধি এবং কর্মসন্তুষ্টি নিশ্চিত করা শিল্প মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য। তাছাড়া কর্মচারী কর্মকর্তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য কর্মের উপযুক্ত মানসিক এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা, শিল্পক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হ্রাস করা এবং কর্মচারীদের কর্মসন্তুষ্টি নিশ্চিত করা শিল্প মনোবিজ্ঞানের অপর একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিকদের মধ্যে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক, মালিক সম্প্রীতি স্থাপন, কর্মী নির্বাচন, কর্মে কৃতিত্ব অর্জন, কর্মচারীদের সম্মান বৃদ্ধি, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধন বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিল্প মনোবিজ্ঞানিগণ সাহায্য সহযোগিতা করে থাকেন। অতএব বলা যায় যে, শিল্পকারখানায় জনশক্তির সঠিক ব্যবহার করে শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করা শিল্প মনোবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য।

শিল্প মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য কার্যাবলি: শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রধান কাজ হলো শিল্প সম্পর্কিত ক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণ অনুসন্ধান করা এবং আচরণ সম্পর্কিত এসব সংগৃহীত জ্ঞান শিল্প ও কারবারে নিয়োজিত মানুষের মানসিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা। শিল্পকারখানার একনিকের বিশাল অংশ জুড়ে আছে যন্ত্রপাতি এবং শিল্পের উৎপাদন এবং অপরদিকে আছে কর্মে নিযুক্ত কর্মীদের আচরণ। কর্মীদের মানসিক অবস্থা, আশা- আকাঙ্ক্ষা, মানসিক শক্তি, যোগ্যতা, মনোবল, আচরণ ইত্যাদি | নির্ধারণ করে শিল্পে কর্মরত জনশক্তির সর্বাধিক সদ্ব্যবহার এবং | সর্বাপেক্ষা উৎপাদন আদায় করাই শিল্প মনোবিজ্ঞারে প্রধান কাজ।

শিল্প মনোবিজ্ঞানের আলোচিত বিষয় : মানুষের আচরণের যেসব দিক শিল্পে পণ্য ও সেবার উৎপাদন, বণ্টন এবং ভোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেসব বিষয় নিয়ে শিল্প মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে। কর্ম বিশ্লেষণ, কর্মচারী নির্বাচন, শিল্পে প্রশিক্ষণ, কর্মসন্তুষ্টি এবং কর্মীর মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, শিল্প শ্রমিকদের দক্ষতার বিকাশ, ক্লান্তির কারণ, দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ, উৎপাদনের ধীর গতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শিল্প মনোবিজ্ঞান কঠোর আলোচনা এবং পর্যালোচনা চালায়। তাছাড়া শিল্প মনোবিজ্ঞান শিল্পকারখানা এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের আচরণ, সমস্যা এবং এর সমাধান নিয়েও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

শিল্প মনোবিজ্ঞানের পরিসর: শিল্প মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি ব্যাপক জনপ্রিয় শাখা। বিশ্বের প্রত্যকটি দেশেই কমবেশি শিল্পকারখানা রয়েছে। আর যেখানেই শিল্পকারখানা রয়েছে, সেখানেই রয়েছে দুর্ঘটনার ভয়, কর্মচারীদের অসন্তুষ্টি এরকম নানা সমস্যা। তাই এসব সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প মনোবিজ্ঞান ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। বৃহত্তর অর্থে শিল্প মনোবিজ্ঞান শিল্পে মানব সম্পর্ক উৎপাদন, উপযোগিতা, যানবাহন, যোগাযোগ, কৃষি, খনিজদ্রব্য, ব্যবসায় বাণিজ্য এবং নানা প্রকার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। এ কারণে এ শাখার পরিধি এবং পরিসর ব্যাপক হতে ব্যাপকতর হচ্ছে, যা ফলিত মনোবিজ্ঞানের প্রসারণের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্প মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, পরিসর পরিধি, আলোচ্যবিষয়, কার্যাবলি সবই মানব আচরণের ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দিককে কেন্দ্র করে সুসমমণ্ডিত। তাই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, শিল্প মনোবিজ্ঞান একটি ফলিত মনোবিজ্ঞান। কারণ শিল্প মনোবিজ্ঞান শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে যথাযথ সুফল পাওয়া যায় এবং শিল্পের প্রত্যাশিত উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। বর্তমান কালে শুধু শিল্প মনোবিজ্ঞানই নয়, শরীরতত্ত্ব মনোবিজ্ঞান, শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, নির্দেশনা মনোবিজ্ঞান, মানব প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি কলিত মনোবিজ্ঞানের আক্রতায় পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!