রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের স্বদেশপ্রেমের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।

অথবা, “কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক”- ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধ অবলম্বনে উক্তিটির সত্যতা যাচাই কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বিদ্রোহী প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে স্বদেশের প্রতি কবির গভীর অনুরাগ ও অনুপম প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত বিদ্রোহের ও প্রেমের কবি। তারপরও সাধারণ মানুষের প্রতি শাসক ও শোষক শ্রেণির লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অপমান এবং ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবেই তিনি অধিকতর সমাদৃত। আর এর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং স্বদেশের প্রতি ঈর্ষণীয় প্রেম।
জবানবন্দীর প্রেক্ষাপট : ব্রিটিশ শাসনাধীন তদানীন্তন ভারতবর্ষে কবির সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় জ্বালাময়ী ও বিপ্লবাত্মক কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরাধীন ভারতবাসী এসব কবিতা ও প্রবন্ধ পড়ে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ হয় এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরিক হতে থাকে। কবি নিজেও শুধু লেখায় নয়, বক্তৃতা ও গানের মাধ্যমে অন্যায় ও অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ব্রিটিশ বিরোধী গণজাগরণ সৃষ্টি ও আন্দোলনের মদদদাতা হিসেবে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। এ সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে এবং একদেশদর্শী প্রহসনমূলক বিচারকার্যের কঠোর সমালোচনা করে তিনি আদালতে পেশ করার জন্য যে প্রতিবেদন রচনা করেন, সেটিই ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত।
উজ্জীবন সূত্র : অসচেতন, কর্মবিমুখ এবং কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন এ উপমহাদেশের মানুষকে বিশ্বকবি বলেছেন ‘আধমরা’। গোলামীর জিঞ্জির পরে তারা তাদের তেজ, বিক্রম, সংগ্রামী চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। বিস্তৃত হয়েছে অতীতের স্বর্ণ ঐতিহ্য। ব্রিটিশ সরকারের অপশাসন, অত্যাচার, জুলুম আর শোষণের শিকার হয়ে তাদের মেরুদণ্ড ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। আর এ কারণে বিশ্বের দেশে দেশে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে যে গণআন্দোলন, তা তাদেরকে জাগাতে পারে নি। এ প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভ-


“বাহির পানে তাকায় না যে কেউ
দেখে না যে বান ডেকেছে
জোয়ার জ্বলে উঠছে প্রবল ঢেউ।”


পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আন্দোলনে যাঁরা ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করেছিলেন- প্রতিবাদ, বিক্ষোভে সামিল হয়ে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম। দেশ, জাতি, ধর্ম, সমাজ যেখানেই তিনি অন্যায়, জুলুম দেখেছেন সেখানেই তিনি বিদ্রোহ করেছেন। দেশ এবং মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি বলতে পেরেছেন-


“বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।”


সত্যের প্রকাশিকা : কবি ন্যায়, সত্য, সুন্দরের পূজারী। তাঁর বুদ্ধি বিবেকের বিচারে যা কিছু কল্যাণকর তা উপস্থাপন করাই তাঁর ধর্ম। আর এসব কিছুই স্বদেশ, স্বসমাজ ও মানুষের বৃহত্তম স্বার্থ ও মহত্তম কল্যাণের জন্য নিবেদিত। এ দিক থেকে উচ্চারণ- প্রত্যেক কবিই দেশপ্রেমিক। কবি নজরুলের কণ্ঠে তাই চিরায়ত কল্যাণেরই সুদৃঢ় “আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়।”
নিজের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস : নিজের প্রতি তাঁর আস্থা এবং বিশ্বাসই তাঁকে দেশের স্বার্থে সত্য উচ্চারণ করতে সাহস যুগিয়েছে— অনুপ্রাণিত করেছে। বিশ্বস্রষ্টার কাছে আত্মনিবেদিত মানুষের কোন দুর্বলতা থাকে না। কোন সঙ্কটও থাকে না। কবি নজরুল নিজেকে হীন, সংকীর্ণ, লোভী বা তোষামোদে মনে করেন না। পার্থিব স্বার্থের কাছে নিজের বিবেককে জলাঞ্জলি দিতে তিনি রাজি নন। কেননা কবি অনাগত অবশ্যম্ভাবী মহারুদ্রের তীব্র আহবান শুনেছিলেন, তাঁর রক্ত আঁখির হুকুম বুঝেছিলেন। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছেন- “কোন কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই; নিজের সাধনালব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই।”
স্বদেশপ্রেমের বিস্তার : তদানীন্তন সরকারের সমস্ত অপকর্মের বিরুদ্ধে, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন কবি। সৈনিক জীবনে তিনি দেখেছিলেন কামাল আতাতুর্কের সংগ্রাম ও বিজয়, স্বাধীনতার উজ্জীবন শক্তির প্রকাশ। স্বদেশে ফিরে দেখেছেন প্রহসনের আইনকানুন, যা রাজশক্তিকে বাঁচানোর জন্যই তৈরি হয়েছে। এদেশের মানুষের প্রতি নির্মম অবিচার, দুঃসহ নিপীড়ন তাঁকে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী করে তুলেছে। সমস্ত ভয়ভীতি, হুমকিকে তুচ্ছ করে তিনি ‘ধূমকেতু’র মত পত্রিকায় লিখে গেছেন অবিরাম। তিনি জানতেন, এ সরকারের মুখোশ খুলে দেয়ার শাস্তি তাঁকে পেতে হবে, প্রথম আঘাত তাঁর বুকেই বাজবে। রাজদ্রোহীর বেশে রাজকারাগারে বন্দী হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি অন্ধ বিশ্বাসে, লাভের লোভে, রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে, অত্যাচারকে স্বীকার করে নেননি। তাঁর যতটুকু ক্ষমতা ছিল তা দিয়েই তিনি তাঁর বিবেকের আদেশ পালন করেছেন। তাই স্বচ্ছন্দে বলেছেন- “আমি এবারকার প্রলয় ঘোষণার সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিক মনে করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, স্বদেশের প্রতি নিজ কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই কবির তৃপ্তি ও প্রশান্তি। নিজেকে তিনি ‘অমৃতের পুত্র’ বলে মনে করেন। পরাধীন, অনাথিনী জননীর দুঃখ মোচনের প্রয়াস যদি স্বদেশের গ্লানিমোচনে কিছু মাত্র কাজে লাগে তাহলেই কবি স্বার্থক। সমস্ত অন্তর প্রবাহে দেশপ্রেম নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এখানে সফল ও প্রোজ্জ্বল।