মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

অথবা, মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে বৈসাদৃশ্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন ইসলামি দর্শন থেকে কিভাবে আলাদা তা আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন ও ইসলামী দর্শনের পার্থক্য সম্পর্কে যা জান লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভই দর্শন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির একটি দর্শন রয়েছে। মুসলিম জাতিরও অনুরূপ এক দর্শন রয়েছে। মুসলিম দর্শন কথাটি অত্যন্ত
ব্যাপক। কারণ প্রথমত, মুসলিম দর্শন কুরআন ও হাদিসে বিধৃত দর্শনকেই বুঝায়। দ্বিতীয়ত, ইসলামি চিন্তার বিকাশ সাধনে বিভিন্ন পর্বে আবির্ভূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বাধীন চিন্তা ও ধ্যান ধারণাকে নির্দেশ করে। সুতরাং মুসলিম দর্শন হচ্ছে জীবন ও মূল্যবোধ বিষয়ক আদর্শ ।
মুসলিম দর্শন : মুসলিম দর্শন হলো মুসলমান জাতির চিন্তাধারার দর্শন, মুসলিম চিন্তাবিদ কর্তৃক জীবন ও জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নের দর্শন। মুসলিম চিন্তাবিদের সার্বজনীন জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর প্রদান করেছেন, জীবন ও জগতের সমস্যাবলি সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তাই মুসলিম দর্শন নামে পরিচিত। মানবজাতির চিন্তার ইতিহাসে মুসলিম চিন্তাবিদরা এক গৌরবময় অধ্যায়ের সংযোজন করেছেন। প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে মানবজাতির চিন্তাধারার মধ্যে অখণ্ড যোগসূত্র রক্ষা করেছেন। মানজাতির চলমান জীবনের বিভিন্নমুখী ক্রমবর্ধমান জটিলতাই মানব চেতনাকে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করে তুলেছে।
ইসলামি দর্শন : কোন কোন চিন্তাবিদগণ ইসলামি দর্শন বলতে এমন দার্শনিক আলোচনাকে বুঝিয়েছেন, যা কেবল ধর্মতত্ত্ব তথা কুরআন ও হাদিসের আলোকে আলোচিত। অর্থাৎ ইসলামি দর্শন হচ্ছে কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা। ইসলামি দর্শনের পরিসর মুসলিম দর্শনের পরিসর থেকে সংকীর্ণতর কেননা ইসলামি দর্শন কেবল কুরআন ও হাদিসে সুষ্ঠুভাবে বর্ণিত অর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দার্শনিক ধারণাবলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। দর্শনের সমস্যাবলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা নির্দেশ করার লক্ষ্যে ‘ইসলামি দর্শন’ কথাটির পরিবর্তে ‘মুসলিম দর্শন’ কথাটি প্রয়োগ করা অধিকতর সমীচীন বলে মনে করা হয়।
মুসলীম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য : মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :
মুসলিম দর্শন হলো মুসলিম চিন্তাবিদদের যেকোন দার্শনিক আলোচনা। হোক সে গ্রিক দর্শনাভিত্তিক, কি কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক। কিন্তু ইসলামি দর্শন হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে কুরআন ও হাদিসভিত্তিক। মুসলিম দর্শনের আলোচনা পরিচালিত ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব প্রজ্ঞার দ্বারা। কিন্তু ইসলামি দর্শন ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা নির্ভর নয়; এটা সম্পূর্ণভাবে কুরআন ও হাদিস নির্ভর।
মুসলিম দর্শনের পরিসর বা ব্যাপ্তি ইসলামি দর্শন থেকে ব্যাপকতর। কিন্তু ইসলামি দর্শনের পরিসর মুসলিম দর্শন থেকে সংকীর্ণতর। মুসলিম দর্শন হচ্ছে মুসলিম চিন্তাবিদদের যেকোন দার্শনিক আলোচনা। কিন্তু ইসলামি দর্শন বলতে তারা এমন দার্শনিক আলোচনাকে বুঝিয়েছেন যা কেবল ধর্মতত্ত্বের আলোকে আলোচিত। মুসলিম দর্শন সকল অন্ধ বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্ত মনে ও মুক্ত চিন্তায় সকল আপ্তবাক্যকে স্বাধীন ও স্বনিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে বিচার বিশ্লেষণ করে এগুলোর যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে থাকে। কিন্তু ইসলামি দর্শন ধর্মীয় আপ্তবাক্যসমূহকে বিনা বিচারে গ্রহণ ও বিশ্বাস করে। তারপর এগুলোর যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা। মুসলিম দর্শনে প্রাধান্য দেয়া হয় বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিতর্ককে। কিন্তু ইসলামি দর্শনে প্রাধান্য দেয়া হয়। অতীন্দ্রিয়বাদকে।
কোন চিন্তাবিদ মুসলিম দর্শনকে ইসলামি দর্শন বলে আখ্যায়িত করতে চান। কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে খুব কম দার্শনিকই বিশুদ্ধ আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন। কিন্তু ইসলামি দর্শন
বলতে যদি আরবি ভাষায় রচিত দর্শনকে বুঝায়; তবে একে ইসলামি দর্শন বলা যায় না, কেননা মুসলিম দর্শনের উপর অনেক গ্রন্থই রয়েছে, যেগুলো আরবি ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষারও রচিত হয়। ইসলামি দর্শনকে মুসলিম দর্শন বলা যায়। কিন্তু মুসলিম দর্শনকে ইসলামি দর্শন বলা যায় না ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। অনেক মুসলিম চিন্তাবিদরা মনে করেন উভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং একটি অপরটির পরিপূরক। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষই কুরআন ও হাদিসের আলোকেই নিজেদের মতামত উপস্থাপন করেছেন। সুতরাং কিছু
দার্শনিক যে দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলিম দর্শনকে মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শন হিসেবে দুটি ধারায় বিভক্ত করতে চেয়েছেন, সেটা যথাযথ নয়, বরং বিভ্রান্তমূলক।