মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, মুসলিম দর্শনে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনে কিভাবে মুতাজিলাদের উৎপত্তি ঘটে এবং পরবর্তীতে বিকাশ লাভ করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাও ।
অথবা, মুতাজিলাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুসলিম দর্শনে যে কয়টি দার্শনিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে মুতাযিলা সম্প্রদায় অন্যতম। এ সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে প্রথম হিজরির শেষ ভাগে। এ সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরোপুরি
প্রজ্ঞাভিত্তিক বা বুদ্ধিভিত্তিক। মুতাজিলারা বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যবর্তী অবস্থানের মতটি পোষণ করেন বলে তাদেরকে মুতাজিলা বলে অভিহিত করা হয়।
মুতাজিলা কারা : মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে প্রথম হিজরির শেষ ভাগে । মুতাজিলা মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ওয়াসিল বিন আতা (৮০ হতে ১৩১ হিজরি)। মুতাজিলারা বুদ্ধিকে সাথে নিয়ে ইসলামকে যৌক্তিকভাবে প্রমাণের প্রচেষ্টা চালান। দ্বান্দ্বিক বিচার বিশ্লেষণের সাহায্যে তারা মুসলিমদের যুক্তি চূর্ণ করে দেন। এর ফলে সমুন্নত ও সুদৃঢ় হয়
ইসলামের ভাবমূর্তি। পরবর্তীতে মুতাজিলারা খলিফা আল মামুনের সমর্থন লাভ করেন। আবু আল-হুদায়েল আল্লাফ এবং নাজ্জাম ছিলেন খলিফা আল মামুনের শিক্ষক এবং স্বভাবতই তিনি তাদের খুব সম্মান করতেন। পরবর্তীতে আল-মুতাসিন ও আল-ওয়াতিক মুতাজিলাদের সর্বাত্মক সমর্থন করেন।
মুতাজিলা মতবাদের উৎপত্তি : ইসলামে স্বাধীন চিন্তার ধারা কখনো রুদ্ধ হয় নি। সময়ের আবর্তে মুসলিম চিন্তাবিদগণ তাদের নব নব চিন্তাধারায় সভ্যতাকে সিক্ত করতে থাকেন। কাদারিয়া চিন্তাবিদগণদের পথ অনুসরণ করে

বিবর্তীকালে এক বলিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে এরা ‘মুতাজিলা’ নামে পরিচিত। মুতাজিলারা ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবাদী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। মুসলিম চিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, কাদারিয়া চিন্তাবিদগণের প্রেরণা ও ধর্মান্ধ খারিজিদের উগ্রপন্থা এ সম্প্রদায়ের আবির্ভাবকে সম্ভব করে তোলে।
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের নামকরণের ইতিহাস : মুতাজিলা সম্প্রদায়ের নামকরণের সাথে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। আর এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু তাই নয়, এ তাৎপর্য এ সম্প্রদায়ের বিশেষ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। মুতাজিলাদের ‘আহলুল ইতিজাল’ বলা হয়। যারা বিশ্বাস ও.অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী অবস্থা সম্পর্কীয়
মতবাদ প্রচার করেন তারা ‘মুতাজিলা’ বলে পরিচিত হন। ঘটনাটি হলো একদিন এক ব্যক্তি সে যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক হাসান আল বসরীর ( ৬৪২-৭২৮ খ্রিস্টাব্দে) সমীপে উপস্থিত হন এবং তাঁকে প্রশ্ন করেন যে, যদি কোন মুসলমান কবীরা গুনাহ করে তবে কি সে মুসলমান থাকবে না কাফের হয়ে যাবে? জবাবে ইমাম বলেছিলেন, সে মোনাফেক বা কপট ব্যক্তি বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু সুবিজ্ঞ ইমামের প্রতিভাবান শিষ্য ওয়াসিল বিন আতা বলেছেন, তার অবস্থান হবে ‘আল মুতাজিলা বায়না মানজিলাতায়নে।’ অর্থাৎ সে ব্যক্তির অবস্থা এমন হবে যে, সে মুসলমানও নয় আবার অমুসলমানও নয়। তাই তার অবস্থান এ দুই অবস্থার মধ্যবর্তী। ইমাম তাঁর মত প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি তার দিকে তাকালেন এবং বললেন ‘ইতাযাল আন্না’ অর্থাৎ তিনি আমাদের দল ত্যাগ করেছেন। ঐদিন হতে ওয়াসিল বিন আতা ও তার অনুসারীরা মুতাজিলা, অর্থাৎ দল ত্যাগী বলে অভিহিত হতে থাকেন। ফলে ওয়াসিল বিন আতা ইমামের দল পরিত্যাগ করে মসজিদের একপ্রান্তে বসে নিজের মতামত প্রচার ও ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। সতীর্থদের মধ্যে একদল লোক তার মত গ্রহণ করলো এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো।
মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বিকাশ : মুতাজিলা চিন্তাবিদগণকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা :
১..বাগদাদী ধারা ও
২..বসরী ধারা।
বসরা দলভুক্ত মুতাজিলাদের নেতৃত্ব দেন ওয়াসিল বিন আতা। তার মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্বে ছিলেন তার সুযোগ্য শিষ্য আমর বিন ওবায়ীদ। তার সতীর্থ ছিলেন আবুল হুষায়ল ওরফে আল্লফ। বসরা দলের আর একজন অন্যতম চিন্তাবিদ ছিলেন আল্লফের শিষ্য আবু ইসহাক ইব্রাহিম বিন সাইয়াল আল নাজ্জাম।। আল নাজ্জামের শিষ্য আব্বাস আল সুলাইসি
এবং আমর বিন বকর আল জাহীর বসরা দলের সুযোগ্য চিন্তাবিদ ছিলেন। অপরপক্ষে, মুতাজিলাদের বাগদাদ দলের আর একজন অন্যতম চিন্তাবিদ ছিলেন বিশার বিন-মুতামির। নুনামা বিন আল আশরাফ ছিলেন বাগদাদ দলের একজন অন্যতম চিন্তাবিদ। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বাগদাদ দলের চিন্তাবিদদের মধ্যে আর যারা খ্যাতি অর্জন করেন, তাদের মধ্যে আন
ইসকারী, জাফর বিন হাবর, জাফর বিন সুরাসসীর অন্যতম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও মুতাজিলাদের বিকাশ : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কাদারিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত মুতাজিলা মতবাদ অনেক উমাইয়া খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। খলিফা ওয়ালিদের পুত্র তৃতীয় ইয়াযিদ মুতাজিলাদের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন দেন। আব্বাসীদের আমলেও মুতাজিলাগণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। খলিফা আল মামুনের সময় ছিল মুতাজিলাদের উৎকৃষ্ট সময়। তিনি খলিফা হারুন অর রশীদ কর্তৃক আরোপিত মুক্ত আলোচনার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং সকল যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্বান ব্যক্তিবর্গকে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান। খলিফার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুতাজিলা পণ্ডিত আবু যুযায়ল ইয়াজদান নামক জনৈক পণ্ডিতের সাথে তত্ত্বালোচনায়
অংশ নেন এবং তর্কযুদ্ধে, ইয়াজদানকে পরাজিত করে খলিফা মামুনের শুভ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর মামুন মুতাজিলাদের কাজীর পদ হতে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদেরকে নিয়োগ দিতে থাকেন। মূলত এদের প্রচেষ্টায় মুতাজিলা মতবাদ বিকশিত হতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুতাজিলাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এক সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং এর দ্বারা তারা তাদের মতবাদসমূহ আরো গণমুখী করতে সমর্থ হয়। যাহোক, মুতাজিলা সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে বৌদ্ধিক অতৃপ্তি হতে, আর সে অতৃপ্তি হলো মুসলিম ধর্মীয় তত্ত্ব সম্পর্কে বুদ্ধির দ্বারা বিচার বিশ্লেষণের অনুপস্থিতি। অন্যদিকে, এটি বিকশিত হয় মুসলিম চিন্তাবিদগণের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার মাধ্যমে।