General Knowledge

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশল সম্পর্কে আলোচনা কর।মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশলসমূহ উল্লেখ কর।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশল সম্পর্কে আলোচনা কর।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশলসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশল সম্পর্কে যা জান তুলে ধর।
অথবা, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের নেতৃত্ব ও কৌশলসমূহ ব্যাখ্যা অথবা, কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের প্রথম দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তুলনা ইতিহাসে বিরল। সুসংগঠিত পাকবাহিনীর সাথে অসম সংগ্রামে বাংলার দামাল ছেলেরা শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় এবং বহু বাধা বিপত্তি
অতিক্রম করে অবশেষে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য পুষ্ট হয়ে বাংলাদেশকে পশু শক্তির কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম
হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ নয় মাসে বাংলাদেশে হাজারো ধারায় রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে এবং স্বাধীনতার জন্য্যআত্মদান করেছে কমপক্ষে ত্রিশ লক্ষ নরনারী, সম্ভ্রম হারিয়েছেন কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার মহীয়সী মাতা ও ভগ্নি, গৃহহারা হয়েছে অন্ততপক্ষে এক কোটি বাঙালি এবং ছিন্নমূল ও সর্বহারা হয়েছেন অসংখ্য মানব সন্তান। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সূর্য উদিত হয়েছে তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে। এখানে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, নেতৃত্ব ও কৌশল সম্পর্কে যথাপরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও কৌশল : মুজিবনগরের অস্থায়ী সরকার মুক্তিসংগ্রামে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এ সংগ্রামী অধ্যায়ে অস্থায়ী সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। প্রথমত, এ সরকার হাজারো স্থানে যুব শক্তিকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। দ্বিতীয়ত, দেশের বিভিন্ন অংশে গেরিলা বাহিনী সংগঠন করে ও তাদের কর্ম প্রচেষ্টার
সমন্বয় সাধন করে জনগণকে সংগ্রামমুখী করে তোলে। তৃতীয়ত, মন্ত্রিসভার সদস্যগণ বিভিন্ন মুক্ত অঞ্চলে ভ্রমণ করে
জাতিকে প্রাণবন্ধ করে রাখেন এবং সীমাহীন সাহায্য ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। চতুর্থত, স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার প্রতিষ্ঠা করে দেশের সর্বত্র মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য প্রচার করে দেশে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব ছিল প্রধানত দুই ধরনের। এক. সামরিক নেতৃত্ব ও দুই. রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বাংলাদেশের প্রবাসী
সরকার (Government-in-Exile) রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান করে এবং মুক্তিবাহিনী সামরিক নেতৃত্ব দান করে। ১৯৭১সালের ১৭ এপ্রিল জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। দক্ষ মুক্তিযুদ্ধের জন্যৎসমগ্র দেশকে চারজন সৈনিকের নেতৃত্বের চারটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় । যথা :
ক. চট্টগ্রাম সেক্টর- মেজর জিয়া (পরে রাষ্ট্রপতি)
খ. কুমিল্লা সেক্টর- মেজর খালেদ মোশাররফ।
গ. সিলেট সেক্টর- মেজর সফিউল্লাহ।
ঘ. কুষ্টিয়া সেক্টর- মেজর ওসমান চৌধুরী।
১৯৭১ সালের ১১–১৭ জুলাই তারিখে সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত কর্মকর্তাদের এক অধিবেশনে মেজর জেনারেল আব্দুর রব এবং এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খন্দকারকে মুক্তিবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও সহকারী স্টাফ প্রধানের পদে নিয়োগ দান করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেকটি সেক্টরকে কতকগুলো উপসেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এ অধিবেশনে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, Z-Force, S-Force, এবং K-Force নামে তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হবে। এ তিন ব্রিগেডের প্রধান ছিলেন যথাক্রমে মেজর জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল সফিউল্লাহ এবং লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধের কৌশল হিসেবে তিনটি নীতি গৃহীত হয় । যথা :
প্রথমত, গেরিলা পদ্ধতি। এ উদ্দেশ্যে এক বিরাট গেরিলা বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত বাহিনী গঠন। নিয়মিত বাহিনী গঠন করে গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতি ছিল এর লক্ষ্য।
তৃতীয়ত, শেষ পর্যায়ে সম্মুখ সমর। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রশিক্ষণ শিবিরে
আনুমানিক দেড় লক্ষ (কারো মতে তা দুই লক্ষেরও অধিক) বাঙালি যুবক-যুবতী অস্ত্রশিক্ষা লাভ করে এবং বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে
অতর্কিতে আক্রমণ পরিচালনা করে তারা পাকবাহিনীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। তাছাড়া, সম্মুখ সমরে সাধারণত অবতীর্ণ না হয়ে অতর্কিত গেরিলা পন্থা অবলম্বন করে পাকবাহিনীর চলাফেরা একরূপ অসম্ভব করে তোলে। রাস্তাঘাট ধ্বংস করে, সেতু বিনষ্ট করে, রেলপথ অচল করে তারা পাকবাহিনীর ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী ও রংপুরের বেশ কিছু অংশ মুক্তিবাহিনীর দ্বারা মুক্ত হয়। এ মুক্তিসংগ্রামের আর
একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় কর্মসূচি নির্বিশেষে সম্মিলিত হয় এবং
অস্থায়ী সরকারের সাথে একাত্মতা স্থাপন করে। কম্যুনিস্ট পার্টির বিভিন্ন উপদল, জাতীয় আওয়ামী পার্টির দুই অংশ এবং
দেশের প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠন এতে আত্মনিয়োগ করে। তবে কায়েমি স্বার্থপুষ্ট সম্প্রদায়ভিত্তিক কিছু ব্যক্তি এ মুক্তিসংগ্রামে
অংশগ্রহণ করেনি, বরং বিভিন্নভাবে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অস্থায়ী সরকার জাতির সর্বশক্তি নিয়োগ করে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সংহত্যকরতে সচেষ্ট হয়। এ সংগ্রাম শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এ সংগ্রাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সংগ্রহ ও বিশ্বমতকে বাংলাদেশের ন্যায়ের সংগ্রামের প্রতি সচেতন হতেও বিশেষভাবে সাহায্য করে। অস্থায়ী সরকার বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি
প্রেরণ করে, এমনকি জাতিসংঘে প্রতিনিধি প্রেরণ করে, প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করে বাংলাদেশের লক্ষ্য ও ন্যায়পরায়ণতার বাণী সর্বত্র প্রচার করতে থাকে। ফলে দেখা যায়, কিছু দিনের মধ্যে মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্র পাকিস্তানের ববরর্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। বিশ্বের নামকরা অধিকাংশ সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে
‘ন্যায়ের সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণে বাংলা হলো স্বাধীন, লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীনতার তীর্থ স্থান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!