মীমাংসা দর্শনের জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব আলোচনা কর।

অথবা, জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব সম্পর্কে মীমাংসকদের মত আলোচনা কর।
অথবা, জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব সম্পর্কে মীমাংসা মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, মীমাংসা দার্শনিকদের মতে জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব প্রত্যয়ত্রয় ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মীমাংসা দর্শনের আর এক নাম ‘জৈমিনি দৰ্শন’ । মীমাংসা দর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচনার সুবিধার্থে মীমাংসা দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. জ্ঞান (Knowledge) ২. তত্ত্ব (Metaphysics) এবং ৩. নীতি ও ধর্ম
(Ethics and Religion)। প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালি বা উপায়। মীমাংসকগণ তাঁদের তত্ত্ববিদ্যার আলোচনায় পদার্থ, জগৎ, শক্তি ও অপূর্ব এবং আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। নিম্নে মীমাংসা দর্শনের তত্ত্ববিদ্যার জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
জগৎ : মীমাংসকগণ জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ ও অনুমানের সাহায্যে জগৎ এবং জাগতিক বস্তুর সত্যতা প্রমাণ করা যায় না। বৌদ্ধ দার্শনিকদের শূন্যবাদ ও ক্ষণিকবাদ, আর অদ্বৈত বৈদান্তিকদের জগৎ- মিথ্যাত্ববাদ-এর কোনটিই মীমাংসকগণ স্বীকার করেন নি। তাঁরা বলেন, যা কিছু আমাদের প্রত্যক্ষগোচর হয় তা সত্য। জগৎ ও জাগতিক বস্তু আমাদের প্রত্যক্ষগোচর হয়। কাজেই জগৎ ও জাগতিক বস্তু সত্য। এ ছাড়াও মীমাংসকগণ অনুমান প্রভৃতি প্রমাণের সাহায্যে আত্মা, স্বর্গ, নরক ও দেবতাদের (যাঁদের উদ্দেশ্যে বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়) অস্তিত্ব স্বীকার করেন। মীমাংসকদের মতে, আত্মা নিত্য এবং জগৎ-উৎপাদনকারী জড় উপাদাগুলোও নিত্য। কর্ম নিয়ম অনুসারে জড় উপাদান হতে জাগতিক বস্তুগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। জগৎ স্রষ্টারূপী কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব মীমাংসকরা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, জগৎ হলো ভোগায়তন (অর্থাৎ যে শরীরে অবস্থান করে আত্মা কর্মফল ভোগ করে), ভোগ সাধন (অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কমেন্দ্রিয়, যার দ্বারা আত্মা কর্মফল ভোগ করে) এবং ভোগ্যবস্তুর (অর্থাৎ জগতের অসংখ্য বস্তু যাদের ভোগ করা যায়) সমষ্টি। কোন কোন মীমাংসক বৈশেষিকদের পরমাণুবাদ স্বীকার করেন। তবে ঈশ্বর পরমাণুর সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণের কর্তা-এ কথা স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে স্বয়ংক্রিয় কর্ম-নিয়মই পরমাণু সংযোগের জন্য দায়ী।
মীমাংসকদের মতে, জগৎ নিত্য। জগতের সৃষ্টিও নেই, ধ্বংসও নেই, যেহেতু এমন কোন সময় নেই যখন কোন জগৎ ছিল না। মীমাংসকদের এ মত ভারতীয় দর্শনের অন্য কোন সম্প্রদায় গ্রহণ করেন না।
শক্তি ও অপূর্ব : কার্যকারণ তত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে মীমাংসকগণ ‘শক্তি’র অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, প্রত্যেক কারণের মধ্যে এক অপ্রত্যক্ষ শক্তি প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে এবং সে শক্তিই কার্য উৎপন্ন করে। কোন প্রকারে যদি ঐ কারণস্থিত শক্তি নষ্ট হয়ে যায় তবে ঐ কারণ হতে কোন কার্য উৎপন্ন হয় না। যেমন- যেকোন বীজে অঙ্কুর. উৎপাদনের শক্তি আছে এবং সে শক্তিই অঙ্কুর উৎপন্ন করে। কোন প্রকারে যদি বীজস্থিত ঐ শক্তি নষ্ট হয় তবে ঐ বীজ হতে কোন অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। যেমন- বীজ শুকিয়ে গেলে বীজের অঙ্কুর উৎপাদনের শক্তি নষ্ট হয় এবং শুকনো বীজ থেকে কোন অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। মীমাংসকগণ আরো বলেন যে, ভিন্ন ভিন্ন কারণের ভিন্ন ভিন্ন শক্তি থাকে। যেমন- বীজের অঙ্কুর উৎপাদনের শক্তি, আগুনের দাহিকা শক্তি ইত্যাদি। কোন বিশেষ কারণ হতে কোন বিশেষ কার্য উৎপন্ন কেন এবং কারণ উপস্থিত থাকলেও কোন কোন সময় কার্য উৎপন্ন হয় না কেন-এসব প্রশ্নের সমাধান মীমাংসকদের ‘শক্তিবাদ’ দিতে পারে। নৈয়ায়িকরা কারণের মধ্যে কোন শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন, কারণের মধ্যে প্রত্যক্ষ শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার না করেও কোন একটি বিশেষ কারণ কোন একটি বিশেষ কার্য উৎপন্ন করে কেন, তা ব্যাখ্যা করা যায়। নৈয়ায়িকদের মতে, কোন রকম প্রতিবন্ধক উপস্থিত না থাকলেই কোন একটি কারণ কার্য উৎপন্ন করতে পারে। আর কোন রকমের প্রতিবন্ধক উপস্থিত থাকলেই কারণ কার্য উৎপন্ন করতে পারে না। নৈয়ায়িকদের এ আপত্তির উত্তরে মীমাংসকরা বলেন যে, কোন কারণের কার্য উৎপাদনের জন্য ঐ কারণের অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকের অনুপস্থিতি নামে কোন পদার্থের অস্তিত্ব যদি স্বীকার করতেই হয় তবে কারণের মধ্যে শক্তির উপস্থিতি স্বীকার করতে দোষ কী? বরঞ্চ নঞর্থক কিছু স্বীকার না করে সদর্থক কিছু স্বীকার করাই সহজ ও স্বাভাবিক। বৈদিক যাগযজ্ঞাদি বর্তমানে সম্পাদন করলে দীর্ঘদিন পরে এমনকি পরজন্মে বাঞ্ছিত ফল প্রসব করে কেমন করে-এ প্রশ্নের সমাধান মীমাংসকরা উপর্যুক্ত শক্তিবাদের সাহায্যে করেছেন। তাঁরা বলেন, ইহকালে অনুষ্ঠিত যজ্ঞাদি যজ্ঞকারীর
আত্মার এক অপ্রত্যক্ষ শক্তি সৃষ্টি করে। এ শক্তিকে মীমাংসকরা ‘অপূর্ব’ নামে অভিহিত করেছেন। এ অপূর্ব যজ্ঞকারীর আত্মায় অবস্থান করে এবং সুযোগ উপস্থিত হলেই যজ্ঞকারীকে তাঁর যথাযথ কর্মফল প্রদান করে। মীমাংসকদের এ অপূর্ববাদ ব্যাপক কর্মবাদের অন্তর্গত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীমাংসকরা তাঁদের তত্ত্ববিদ্যার আলোচনায় জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেছেন। তাইতো মীমাংসা দর্শনের তত্ত্ববিদ্যার আলোচনায় জগৎ এবং শক্তি ও অপূর্ব সম্পর্কীয় আলোচনা ভারতীয় দর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a6%b6%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a6%be/