ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের মত ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের মত আলোচনা কর।
অথবা, ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের অভিমত কী? আলোচনা কর।
অথবা, শঙ্কর ও রামানুজের ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কিত আলোচনাই বেদান্ত দর্শনের মূল উপজীব্য বিষয়। বেদান্ত দর্শনের অন্যতম ভাষ্যকর শঙ্কর ও রামানুজ। উপনিষদকে ভিত্তি করে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
নিম্নে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের মতো আলোচনা করা হলো :
ব্রহ্ম সম্পর্কে শঙ্করের মত : শঙ্করের মতে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্ম স্বরূপ। শঙ্কর ব্রহ্মের সত্তা ছাড়া আর কোন কিছু স্বীকার করেন নি। সে কারণে শঙ্করকে “কেবলা অদ্বৈতবাদী” বলা হয়। ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেন, ব্রহ্ম নিত্য, শুদ্ধ ও মুক্ত। ব্রহ্ম অসীম অনন্ত ও নির্গুণ। তাঁর মতে, আত্মাই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ও আত্মার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। শঙ্কর বলেন, ব্রহ্ম সৎ চিৎ ও আনন্দ স্বরূপ। ব্রহ্ম সৎ অর্থ তিনি অসৎ নয়। ব্রহ্ম চিৎ অর্থ তিনি জড় নয় এবং ব্রহ্ম আনন্দস্বরূপ অর্থ তিনি দুঃখ স্বরূপ নয়। ব্রহ্ম নির্বিশেষ অর্থাৎ তার কোন বিশেষ নেই। তাই ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে হলে তিনি এ নয়, তিনি ঐ নয় ইত্যাদির সাহায্যে উপলব্ধি করতে হবে।
শঙ্করের মতে, দুই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গি হতে ব্রহ্মকে বর্ণনা করা যায়। যথা : ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো অজ্ঞানতা প্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎ সত্য এবং ব্রহ্ম এ জগতের সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও সংহারকর্তা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম নানাবিধ গুণে সমন্বিত। তিনি সর্বত, সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান পুরুষ। এ গুণবান ব্রহ্মকেই শঙ্কর সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ঈশ্বরেরই পূজা অর্চনা হয়। অন্যদিকে, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো জ্ঞান প্রসূত। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম জগতের স্রষ্টা, রক্ষক বা সংহার কিছুই নয়। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তার কোন প্রকার প্রকারভেদ নেই। অর্থাৎ ব্রহ্মের স্বজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ নেই। পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রহ্ম সত্য-জ্ঞানও অনন্ত। এটি ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ। শঙ্করের মতো পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্মকে পরব্রহ্ম বলা হয়। উপনিষদে ব্রহ্মের দুটি রূপের কথা বলা হয়েছে। যথা : পরব্রহ্ম ও অপরাব্রহ্ম। শঙ্করের পরব্রহ্ম হলো নির্জন আর অপরাব্রহ্ম হলো সগুণ ব্রহ্ম। উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্ম বিশ্বজগৎ ও বিশ্বাতীত। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শঙ্কর বলেন, যতক্ষণ জগৎ প্রপঞ্চ বিদ্যমান
থাকে ততক্ষণ জগৎ ব্রহ্মেই অধিষ্ঠিত থাকে এবং ব্রহ্মও বিশ্বজগত হন। যেমন- ভ্রমাত্মক জ্ঞানবশত মিথ্যা সর্প রজ্জুতে অধিষ্ঠিত থাকে এবং রজ্জু ও সর্পকে অভিন্ন মনে হয়। সর্প যেমন রজ্জুকে কলুষিত করতে পারে না তেমনি জগত প্রপঞ্চও ব্রহ্মকে কোন রকমে কলুষিত করতে পারে না। আলোর সাক্ষাতে রজ্জু হতে মিথ্যা সর্প যেমন বিলুপ্ত হয় এবং রজ্জু স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। তৈমনি বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জগত প্রপঞ্চ বিদ্যমান থাকে না এবং ব্রহ্ম স্বরূপে অধিষ্ঠিত হন। সুতরাং বিজ্ঞ ব্যক্তিদের চিন্তায় ব্রহ্ম বিশ্বাতীত । এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম সগুণ হলেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে তিনি নির্গুণ। শঙ্করের মতে, পারমার্থিক দৃষ্টিভঙ্গিই সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি। তবে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের উপাসনার উপকারিতা শঙ্কর অস্বীকার করেননি। তাঁর মতে, ঈশ্বরের উপাসনার চিত্ত হয় এবং চিত্ত শুদ্ধ ব্যতিরেকে নির্গুণ ব্রহ্মের কোন ধারণাই হয় না।
ব্রহ্ম সম্পর্কে রামানুজের মত : রামানুজের মতে, ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। তিনি চিৎ, অচিৎ বিশিষ্ট পরম সত্তা। তার বাইরে কোন বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা নেই। কিন্তু অভ্যন্তরে চিৎ ও অচিৎ এ দুই সত্তা বিদ্যমান। চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মেরই দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রহ্ম যেমন নিত্য তার অংশগুলোও নিত্য। রামানুজের মতে, চিৎ ও অচিৎ বিশিষ্ট ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়।
সে কারণে তার মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয় । রামানুজের মতে, ব্রহ্ম ভেদহীন নয়। তিনি ব্রহ্মের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ স্বীকার করেন নি। কিন্তু স্বগত ভেদকে স্বীকার করেছেন। কেননা ব্রহ্মের অভ্যন্তরে জীব ও জড় রয়েছেন। তাঁর মতে, ব্রহ্ম অসংখ্য সৎ গুণের অধিকারী। তিনি জগতের স্রষ্টা, রক্ষক এবং সংহারক। জগত সৃষ্টির সময় ব্রহ্মের চিৎ অংশ জীবে পরিণত হয় আর অচিৎ অংশ জড়জগতে পরিণত হয়। আর প্রলয়ের সময় জাগতিক মূল বস্তুগুলো এবং জীবদেহ ধ্বংস হলেও অব্যক্ত রূপে জড় (অচিৎ) এবং জীবাত্মা (চিৎ) ব্রহ্মের এ অংশরূপে অবস্থান করে। ব্রহ্মে চিৎ ও অচিৎ যখন অব্যক্তরূপে অবস্থান করে তখন ব্রহ্মকে কারণ, ব্রহ্ম বলা হয়। আবার সৃষ্টির পরে যখন ব্রহ্মের চিৎ ও অচিৎ অংশ ব্যক্ত হয় তখন তাকে কার্য ব্রহ্ম বলা হয় । এখন প্রশ্ন হলো রামানুজ যেহেতু জীব ও জড়কে ব্রহ্মের অংশ বলেছেন সেহেতু বলা যায় জড়ের পরিবর্তনের সাথে জীবের সুখদুঃখের দোষত্রুটিকে ব্রহ্মের সুখদুঃখ ও দোষত্রুটি বলা যায়। ফলে ব্রহ্ম সাথে ব্রহ্মেরও পরিবর্তন হয় এবং পরিণামী ও দোষযুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এটি ব্রহ্মের স্বভাব বিরুদ্ধ। ব্রহ্ম স্বভাবতই অপরিনামী ও সর্বদোষ বর্জিত। এ
প্রশ্নের উত্তরে রামানুজ বিভিন্ন উপমার সাহায্য নিয়েছেন। একটি উপমায় তিনি বলেছেন— ব্রহ্ম হলো আত্মা এবং জড় ও জীব হলো তাঁর দেহ। তিনি দেহের অন্তরস্থিত আত্মা যেমন দেহকে নিয়ন্ত্রিত করে তেমনি ব্রহ্ম ও জীব এবং জগতকে নিয়ন্ত্রণ করেন। দেহের পরিবর্তনে যেমন আত্মার পরিবর্তন হয় না। তেমনি জড়জগৎ এবং জীবের পরিবর্তনেও ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন হয় না।জীব ও জড়ের সঙ্গে ব্রহ্মের সম্পর্ক বুঝবার জন্য রামানুজ রাজা প্রজার উপমা উপস্থাপন করেছেন। তিনি ব্রহ্মকে রাজা এবং জড়
ও জীবকে প্রজা বলেছেন। রাজা যেমন প্রজাদের শাসন করেন কিন্তু প্রজাদের দোষত্রুটি তাকে স্পর্শ করে না তেমনি ব্রহ্মও জীব ও জগৎকে নিয়মিতরূপে পরিচালিত করেন। কিন্তু জীব জগতের দোষত্রুটি তাকে স্পর্শ করে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে শঙ্কর ও রামানুজের মতের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। তবে পার্থক্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল আছে। আর তা হলো তারা উভয়ই ব্রহ্মকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। ব্রহ্মের উপাসনাকেই জীবের মুক্তির উপায় বলে বর্ণনা করেছেন।https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/