• May 31, 2023

বেগম রোকেয়ার ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠনের উদ্দেশ্য এবং এর কার্যাবলি উল্লেখ কর।

অথবা, বেগম রোকেয়া ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেছিলেন কেন? এর কার্যাবলি আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীর মুক্তি ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী আত্যন্তিক সাধনা ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ স্বগোত্রীয় মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি। নারীমুক্তির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলার মুসলমান নারীসমাজ তথা দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে তিনি অসীম পুণ্যের অধিকারী হয়েছেন। তিনি যেমন নারী জাগরণের অগ্রদূত তেমনি পুণ্যময়ী। একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলার কূপমণ্ডূকতা মুসলমান নারীসমাজকে তিনিই সর্বপ্রথম মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তিনিই প্রথম মুক্তিপথে তাদেরকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। এ কারণে তিনি মুসলিম নারী জাগরণের দিশারী হয়ে থাকবেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত পুণ্যময়ী বেগম রোকেয়ার ইহলোক ত্যাগের অর্ধশতাব্দীকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এদেশের নারী জাগরণ তথা দেশ ও জাতির ইতিহাসে তাঁর অবদান অমলিন হয়ে আছে।
মুসলিম মহিলা সমিতি স্থাপনের পটভূমি : মুসলিম বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উনিশ শতকের শেষভাগে মুসলমান মেয়েদের চলার পথকে সুগম করার জন্য কতিপয় মুসলমান যুবক আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। তারা তাদের পাঠ্য জীবনে ১৮৮২ সালে ঢাকায় সুহৃদ সম্মিলনী নামে এক সমিতি স্থাপন করেন। এ সমিতির উদ্যোক্তাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন নোয়াখালীর মৌলবি আবদুল আজিজ, মৌলবি ফজলুল করীম, মৌলবি বজলুর রহিম ও বরিশালের মৌলবি হিমায়িৎ উদ্দিনপ্রমুখ। মুসলিম বাংলায় ইংরেজি শিক্ষাকে যারা সকলের আগে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে এ কয়জন উল্লেখযোগ্য। সুহৃদ সম্মিলনীর মাধ্যমে তারা স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতা সম্পর্কে উদার মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। যে নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত দেশ জুড়ে স্কুল, কলেজ হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ করেন, ঠিক সে নিয়মে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে মেয়েদের জন্য গৃহে গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন।মুসলমান সমাজে যখন ছেলেদের মধ্যেও শিক্ষার বিস্তার সন্তোষজ নক ছিল না, সে সময়ে সুহৃদ সম্মিলনীর উদ্যোক্তারা কেন স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে এত উৎসাহী ছিলেন তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজের কেউ কেউ এমন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছেন। ১৮৮৬-৮৭ সালের পর ‘সুহৃদ সম্মিলনী’ সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় নি। উনিশ শতকের শেষার্ধে ১৮৮৭ সালে নেতৃস্থানীয় হিন্দু মহিলাদের দ্বারা ‘সখি সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছিল।সমিতির প্রতিষ্ঠাত্রী ও সম্পাদিকা ছিলেন ঠাকুর পরিবারের সুকন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি ছিলে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।স্বর্ণকুমারী দেবীর জাতিগঠনমূলক কার্যকলাপ প্রধানত হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ প্রতিষ্ঠানই নারী শিক্ষাবিস্ত ণরের উদ্দেশ্যে ব্যাপক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল কি না তা জানা যায় নি।
মুসলিম মহিলা সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য : ১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া প্রচেষ্টায় ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ স্থাপিত হয়। মুসলমান নারীসমাজের পশ্চাৎপদতার কারণগুলো বেগম রোকেয়া তাঁর অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুসলিম নারীসমাজের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যেসব কুপ্রথা ও কুসংস্কার প্রচলিত, আছে এবং যেসব কূপমণ্ডূকতা আছে সেগুলো দুরীভূত করে মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের মহতী উদ্দেশ্যে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার
জীবনব ্যাপী সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এ সমিতি।
মুসলিম মহিলা সমিতির কার্যাবলি : জাতিগঠনের কাজের জন্য ‘আঞ্জুমানের খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতির’ নাম ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয়।নিম্নে এর কার্যাবলি উল্লেখ করা হলো :
১. বিধবা রমণীদের অর্থদান : মুসলিম মহিলা সমিতি বাংলার অসহায় নারীসমাজের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল। বিধবা অসহায় মহিলাদের এ সমিতি আর্থিক সাহায্য করত, যাতে সে অর্থ নিয়ে তারা কিছু করতে পারেন।তাদের পারিবারিক জীবনে কিছুটা হলেও সুখস্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে।
২. চরিত্রহীন স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে অসহায় বধূকে রক্ষা : শিক্ষাহীন, জ্ঞানহীন, কুসংস্কারে নিমজ্জিত বাঙালি নারীরা ছিল অসহায়। বিয়ের পর স্বামীই এবং স্বামীর ঘরই তাদের একমাত্র অবলম্বন। শত অত্যাচার ও নির্যাতন তারা মুখ বুঝে সহ্য করত। কোন প্রতিবাদের উপায় তাদের ছিল না। মুসলিম মহিলা সমিতি এসব অসহায় মহিলাদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানসিক ও আর্থিক স্বাবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। এ সমিতি চরিত্রহীন, লম্পট স্বামীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে এসব অসহায় দুস্থ মহিলাদের রক্ষা করে স্বনির্ভর করেন।
৩. বয়ঃপ্রাপ্ত দরিদ্র কুমারীকে সৎপাত্রস্থ করা : মুসলিম অনেক দরিদ্র পরিবার আছে, যে পরিবারে বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে বিয়ে দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই। তারা অভাবের তাড়নায় দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও ঠিকমতো পায় না। এসব পরিবারের মেয়েদের সৎপাত্রের কাছে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এ মুসলিম মহিলা সমিতি।
৪. অভাবগ্রস্ত মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণে নানাভাবে সাহায্য করা : মুসলিম মহিলা সমিতি মুসলমান সমাজে নারীদের সার্বিক কল্যাণে এগিয়ে এসেছিল। অভাবগ্রস্ত অনেক মেয়ের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অভাবের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত না। এ সমস্ত অভাবগ্রস্ত মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ দিত মুসলিম মহিলা সমিতি।
৫. সমাজ পরিত্যক্তা ও দুস্থ মহিলাদের সাহায্য দান : উনিশ শতকের তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ছিল কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ। তখন সামাজিক যেসব নিয়মকানুন ছিল তা অত্যন্ত কঠোর। বিশেষ করে তৎকালীন সমাজে নারীরা হয়েছিল এ কঠোরতার স্বীকার। এ নিয়মকানুন যদি কেউ ভাঙত তাহলে তাকে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া হতো। এসকল দুস্থ, অবহেলিত মহিলারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে মুসলিম মহিলা সমিতি।
৬. অনাথ শিশুদের সাহায্য করা : সমাজে অনাথ শিশুদের নানাভাবে সাহায্য করেছে মুসলিম মহিলা সমিতি। এসব শিশুদের শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করেছে এ সমিতি। সমাজে মুসলিম মহিলা সমিতি ছিল সকল সামর্থ্যহীনদের পাশে।
৭. বাংলার অবরোধবন্দিনী মুসলমান নারীসমাজকে ঘরের অন্ধকার থেকে বাইরে আনা : বাংলার নারীসমাজ তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছিল অবরোধবন্দিনী। সমাজে অশিক্ষা, অজ্ঞানতা ও কূপমণ্ডূকতার প্রভাব এত বেশি ছিল যে, নারীরা ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগটুকুও পায় নি। উপরন্তু পর্দা প্রথার নামে কঠোর অবরোধ প্রথা তাদের শিক্ষাদীক্ষা সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। কঠোর অবরোধ থাকার দরুন শুধু শিক্ষা থেকেই নয়, জীবনের বহু বিচিত্র দিক যেমন- স্বাস্থ্য এবং মনের প্রফুল্লতা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিকাশ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিল। এককথায় ঊনবিংশ
শতাব্দীতে অবরোধ প্রথার অভিশাপে মুসলমান নারীসমাজের স্বাধীন বিকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলার অবরোধবন্দিনী মুসলমান নারীসমাজকে ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে বাইরের দীপ্ত আলোয় এসে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলা সমিতি বা আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
৮. ব াংলার মুসলমান নারীসমাজকে তাদের দুর্গতি সম্বন্ধে সচেতন করা : ঊনবিংশ শতাব্দীর সে অন্ধকার যুগে নারীরা যে সমাজে অসহায়, অবহেলিত অবস্থায় ছিল তাতেই তাঁরা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। এ নারীসমাজকে তাদের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে সমাজে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছে মুসলিম মহিলা সমিতি।
৯. নারীর অধিকার আদায় : মুসলিম নারীরা সে যুগে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা ও তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলা সমিতি ছিল সবসময় সচেষ্ট।
পর্যালোচনা : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, বেগম রোকেয়ার মুসলিম মহিলা সমিতি জাতিগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেগম রোকেয়ার জীবনচরিত্রকার বলেছেন, কলিকাতার মুসলমান নারীসমাজের গত বিশ বৎসরের ক্রমোন্নতির ধারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা করলে স্পষ্টই বুঝা যায়, এ সমিতি দীর্ঘকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে মুসলমান সমাজকে কতখানি ঋণী করে রেখেছে।
সমালোচনা : সমালোচকগণ বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের বিকৃত ব্যাখ্যা দান করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলন প্রভাবিত হয় নি। তিনি যে শিক্ষা প্রচার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিলেন তা পাশ্চাত্য শিক্ষার স্পর্শমুক্ত। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত নারীমুক্তি আন্দোলন তাঁদের মতে নগ্নতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার পথ গ্রহণ করতে বাধ্য।
উপসংহার : বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনকে যারা ব্যঙ্গ করেন তাঁরা বিশেষ উদ্দেশ্যেই তা করে থাকেন। এসব সমালোচনা ভিত্তিহীন। পরিশেষে বলা যায়, বেগম রোকেয়ার প্রতিভায় বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাবেশ আমাদের মুগ্ধ করে। শিক্ষা প্রচার আন্দোলন ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে অভিযান গড়ে তোলার জন্য তিনি শক্তিশালী হাতে লেখনী’ ধারণ করেছিলেন। ধ্রুবতারার মত একটি লক্ষ্যের প্রতি তাঁর সমস্ত কর্ম পরিচালিত হয়েছিল সে লক্ষ্য নারী জাগরণ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a6%b6-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a7%87%e0%a6%97%e0%a6%ae-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%95%e0%a7%87/
হ্যান্ডনোট থেকে সংগ্রহীত
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!