অথবা, বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ আলোচনা কর।
অথবা, বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে তোমার ধারণা ব্যক্ত কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিশ্বায়নের ফলে উত্তরের উন্নত ও দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের ভিন্নতা দেখা দেয়। পূর্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সম্মেলনে উভয়ের স্বার্থের ভিন্নতা সুকৌশলে চাপা থাকলেও ২০০৩ সালের কানকুন সম্মেলনে স্বার্থের ভিন্নতা পরিস্ফুট হয়ে উঠে এবং সিদ্ধান্ত বিহীনভাবে উক্ত সম্মেলনের সমাপ্তি হয়। তাই বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, প্রযুক্তির উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও একত্রিত করা, বাজার খুলে দেয়া, স্বাধীনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা, উন্নয়ন কার্যক্রমকে উদারীকরণ করা, অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবিলা করা, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং একত্রীকরণ করাকে বিশ্বায়ন বলে।
বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ (Future of globalization) : নিম্নে বিভিন্ন সম্মেলনের কার্যকারিতা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎসম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, বিশ্বায়নের কার্য প্রক্রিয়া শুরু হয় মূলত ১৯৯১ সালে সিয়াটলে অনুষ্ঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) এর মাধ্যমে। কিন্তু বিশ্বায়ন বিরোধীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মুখে বাণিজ্য আলোচনার প্রথম চেষ্টাটিই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মূলত এ সংগ্রামের জন্ম হয়েছিল ধনীগরিবের স্বার্থের ভিন্নতা এবং উভয়পক্ষের স্বার্থের অক্ষুণ্নতা রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে। বিশ্ব
পরিবেশ, শ্রমমান ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ন্যায় উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য স্পর্শকাতর বিষয় সংযুক্তির বিরোধিতা থেকে সিয়াটল সংগ্রাম চরম রূপ ধারণ করে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়নের পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মেক্সিকোর পর্যটন নগরী কানকুনে। এখানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো বিশ্বদারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখার মিথ্যা অভিনয় করে পরিবেশ ও শ্রমমানের বিষয় দুটি সুকৌশলে বাদ দিয়ে নিজেদের দেশের কৃষক গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। মূলত ১৯৮১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যে নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি হলো ২০০৩ সালের কানকুনে অনুষ্ঠিত সম্মেলন।
তৃতীয়ত, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো বিপুল জনশক্তির অধিকারী। তারা উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে এ জনশক্তির অবাধ রপ্তানি প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু উত্তরের উন্নত দেশগুলো তা তো হতেই দেয় নি বরং তারা তাদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে আরো কঠোরতা অবলম্বন করেছে। আমেরিকা ও ইউরোপ অর্থনৈতিক দিক থেকে যেভাবে নিজেদের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে, তাতে অনেকে মন্তব্য করেছেন যে, ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে আসছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। ফলে দক্ষিণের দেশগুলো দারিদ্র্য ও বেকারত্বের অভিশাপে ঘুরপাক খাচ্ছে ।
চতুর্থত, শোষণমূলক গ্যাট (GATT) চুক্তির মধ্য দিয়ে যে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) উদ্ভব ঘটে তার প্রভাবেই দরিদ্র দেশগুলো আরো দরিদ্র হচ্ছে আর ধনী দেশগুলো আরো ধনী হচ্ছে। ওয়াশিংটন, সিয়াটল, কানকুন সম্মেলনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, উত্তরের ধনী দেশগুলো এমন কোনকিছু মানতে রাজি নয় যার ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান অধিকতর উন্নত করার পথে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলো নিজেদের কৃষিখাতে ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে সস্তায় তাদের খাদ্যশস্যের যে বা
জার গড়ে তুলেছে তারা তা হারাতে রাজি নয়।
পঞ্চমত, মেক্সিকোর কানকুন সম্মেলনে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ধনী দেশগুলো রাজনৈতিকভাবে কৃষকদের লবির উপর নির্ভরশীল । উত্তরের দেশগুলোর এরূপ মনোভাব বুঝতে পেরে দরিদ্র দেশগুলোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারত, চীন ও ব্রাজিলের নেতৃত্বে কানকুন সম্মেলনের মাধ্যমে শক্তিশালী একটি দলের উত্থান ঘটে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে। এ শক্তি মার্কিন • ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে নামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থের ভিন্নতা পরস্পরবিরোধী। উভয়পক্ষ যদি তাদের নিজ স্বার্থ রক্ষায় অনঢ় থাকে, তাহলে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তবে কানকুন বাণিজ্য আলোচনার ব্যর্থতাকে বিশ্লেষকগণ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য আলোচনার পথে নতুন মোড় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে উন্নত ও অনুন্নত সব দেশ যদি উভয়ের স্বার্থ মোটামুটিভাবে সংরক্ষণ করে, তাহলে বিশ্বায়ন বিশ্বের মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে এতে কোন সন্দেহ নেই।