বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁইমাচা’ গল্পে তৎকালীন সমাজের যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা আলোচনা কর।

অথবা, ‘পুঁইমাচা’ গল্প অবলম্বনে তৎকালীন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজের ভাষাচিত্র অঙ্কন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁইমাচা’ একটি সার্থক সামাজিক ছোটগল্প। গল্পটিতে গল্পকার তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আর্থসামাজিক চিত্রটি তুলে ধরেছেন। সহায়হরি চাটুয্যে নামক এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের পারিবারিক জীবনালোখ্যের দৃশ্যপটে তখনকার সমাজ জীবনটি মূর্ত হয়ে উঠেছে। নিম্নবিত্ত এই পরিবারে সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, আশা-নিরাশার ছন্দদোলায় দোলায়িত দৈনন্দিন জীবনই গল্পটির মূল ভিত্তিভূমি। নিম্নে ‘পুঁইমাচা’ গল্পে বিধৃত সমাজচিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
রক্ষণশীল সমাজ : ‘পুঁইমাচা’ গল্পে বর্ণিত সমাজ একটি ঘুণে ধরা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ। এই সমাজেরই এক অসহায় প্রজা সহায়হরি চাটুয্যে। সহায়সম্বলহীন এই দরিদ্র ব্রাহ্মণের সামাজিক কোন গুরুত্ব ছিল না। তাঁর চার কন্যার প্রথমা কন্যা ক্ষেন্তির বয়স বিবাহোত্তীর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে স্ত্রী অন্নপূর্ণার রাতের ঘুম ও দিনের বিশ্রাম হারাম হয়ে গিয়েছিল। সমাজের কঠিন।শাসনের ভয়ে ভীত হয়ে সহায়হরি মণিগাঁয়ের শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সাথে ক্ষেন্তির বিয়ে স্থির করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে ছেলেটির স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে খারাপ কিছু জানতে পেরে সহায়হরি সে বিয়ে ভেঙে দেন। এই কর্মকাণ্ডের কারণে তৎকালীন সমাজ ক্ষেন্তিকে উৎসর্গ করা লগ্নভ্রষ্টা মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে। সহায়হরিকে অনতিবিলম্বে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয় সমাজপতিরা। তাঁকে এই অপরাধে একঘরে করে রাখার হুমকিও দেয়া হয়। তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এমনি ধরনের সামাজিক নির্যাতনে জর্জরিত ছিল। এ সমাজে নিম্নবিত্ত মানুষ ছিল একান্তই অসহায়। এ ধরনের সামাজিক কালাকানুনের দ্বারা মানবিকতা হতো পদে পদে লাঞ্ছিত।আর্থসামাজিক অবস্থা : কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্পে বর্ণিত তখনকার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অসচ্ছল। সহায়হরি ও অন্নপূর্ণার সাংসারিক টানাপোেড়নের যে চিত্রটি গল্পে ফুটে উঠেছে তার মধ্য দিয়েই সমগ্র সমাজের আর্থিক দুগর্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ধারকর্জ করে মেয়ে ক্ষেন্তিকে বিয়ে দিয়ে যৌতুককের বাকি আড়াইশ টাকা পরিশোধ করতে না পারার
কারণে ক্ষেন্তিকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। এছাড়া পারিবারিক অনটনের কারণে সহায়হরিকে দেখা গিয়েছে অন্যের কাছ থেকে এটা ওটা চেয়ে আনতে। দুই পয়সার বাকি চিংড়ি মাছ নেয়ার কারণে ক্ষেন্তিকে গয়া বান্ধীর কথা শুনতে হয়েছে। এমনকি ব্রাহ্মণ হয়েও সহায়হরি নির্লজ্জের মত অরক্ষণীয়া মেয়েকে নিয়ে বরজপোতার জঙ্গল থেকে মেটে আলু চুরি করে এনেছে। এই ব্রাহ্মণ
পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা সমগ্র সমাজের দীনতাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে।
যৌতুকের বলি : সমাজের চাপে পড়ে এক বৈশাখ মাসের প্রথমদিকে সহায়হরির দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের ঘটকালিতে
ক্ষেন্তির বিবাহ হয়ে গেল । দ্বিতীয়পক্ষের বর হলেও পাত্রটির বয়স চল্লিশের খুব বেশি হবে না। অন্নপূর্ণার এ বিবাহে সম্মতি ছিল না।
কিন্তু সঙ্গতির অভাবে শেষপর্যন্ত রাজি হলো। বিবাহের পর কন্যা বিদায় হলেও সহায়হরির অশান্তি দূর হলো না। বিবাহে যে যৌতুক দেওয়ার কথা ছিল তা পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় আড়াইশ টাকা বাকি রয়ে গেল। যৌতুকের এই বাকি টাকার কারণে মৃত্যুর
পূর্বপর্যন্ত ক্ষেন্তির আর পিত্রালয়ে আসা হলো না। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় অকালমৃত্যু হলো তার। সামাজিক ব্যাধি যৌতুকের বলি হতে হলো হতভাগিনী ক্ষেন্তিকে।
সামাজিক অন্ধত্ব : তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে অন্ধত্ব শিকড় গেড়ে বসেছিল। পাকা ক থা হয়ে যাওয়ার পর বিবাহ ভেঙে যাওয়ার কারণে অরক্ষণীয়া ক্ষেন্তিকে উচ্ছৃগু করা (উৎসর্গ করা) মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত হতে হয়েছে। একই অপরাধে সহায়হরিকে একঘরে করে রাখার হুমকি দিয়েছে সমাজপতিরা। যে কোন কারণে একটা মেয়ের বিবাহ ভেঙে যেতেই পারে। এক্ষেত্রে মেয়ে বা মেয়ের পরিবারের দোষ কেন হবে এর কোন সদুত্তর পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে বিবাহ ভেঙে যাওয়া পাত্রকে উৎসর্গ করা পাত্র বলেও আখ্যায়িত করা হতো না। সমাজের এই গোঁড়ামিকে অন্ধত্ব ছাড়া আর কি বলা যায়? এই সামাজিক অন্ধত্বের কারণে তৎকালীন সমাজে ক্ষেন্তির মতো অসংখ্য মেয়েকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে; সহায়হরির মতো অসংখ্য বাপকে ধিকৃত হতে হয়েছে; অন্নপূর্ণার মতো অসংখ্য মাকে সামাজিক অশান্তি ভোগ করতে হয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ‘পুঁইমাচা’ গল্পে যে সমাজের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সে সমাজ ঘুণে ধরা এক রক্ষণশীল সমাজ। এ সমাজে সমাজপতিদের মনগড়া বিধিবিধানের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে সহায়হীন সম্বলহীন, বিত্তহীন, শক্তিহীন অসহায় মানুষ। এ সমাজে মানবাধিকার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। বিচারের বাণী প্রতিনিয়ত কেঁদেছে নীরবে এবং নিভৃতে। ক্ষেন্তি, সহায়হরি ও অন্নপূর্ণারা রক্ষণশীল এই সমাজের অসহায় বলিতে পরিণত হয়েছিল। এ সমাজে জন্মই ছিল এদের আজন্ম পাপ ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%81%e0%a6%87%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9a%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a7%82%e0%a6%b7/