বাঙালি দর্শনে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান কী?

অথবা, বাঙালি দর্শনে নজরুলের ভূমিকা কী?
অথবা, বাঙালি দর্শনে নজরুলের গুরুত্ব কী?
উত্তর৷৷ ভূমিকা :
পৃথিবীতে অনেক দার্শনিক রয়েছেন যাদের দর্শন চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে তাদের সাহিত্যের মধ্যে। বাঙালি ও পাশ্চাত্য দর্শনের ক্ষেত্রে এরূপ দেখা যায়। বাঙালি দার্শনিকদের দর্শন চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন কাব্যে, গানে, উপন্যাসে ও নাটকে। কাজী নজরুল ইসলামের দর্শন চিন্তাকে এভাবেই আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে মানব চিন্তা চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনা প্রাপ্তি প্রভৃতিকে আঞ্চলিকতার সীমা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতার পরিসরে টেনে নিয়ে এসেছেন। সমাজের সকল শ্রেণির জন্যই তিনি লেখনী ধারণ করেছেন।
বাঙালি দর্শনে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান : কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের সাথে দর্শনের জীবনকেন্দ্রিক অর্থ ও ব্যঞ্জনার নিরিখেই জীবনদর্শন রচনা করেছেন। দারিদ্র্য, যুদ্ধ, শোষণ প্রভৃতি প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি মুক্তির সংগ্রাম করে গেছেন। নিম্নে বাঙালি দর্শনে তাঁর অবদান আলোচনা করা হলো :
১. বিদ্রোহী মনোভাব : কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার বিষয়াবলি তার চিন্তা চেতনায় প্রভা বিস্তার করে তাঁকে করে তুলেছে বিদ্রোহী মনোভাবসম্পন্ন। যে কারণে তাঁর মধ্যে রয়েছে বিপ্লবী চেতনা।
২. মানবধর্মী চিন্তা : নজরুলের দর্শন হলো মানবতাবাদী বা মানবধর্মী দর্শন। তিনি সর্বহারাদের জয়গান গেয়েছেন। সাধারণের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করেছেন।
৩. ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি : নজরুলের সাহিত্যে আমরা যে দার্শনিক তত্ত্ব পাই তা ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিপূর্ণ।বাঙালি দর্শনে তাঁর এ ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর দর্শনকে মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন করে তুলেছে।
৪. বৈশ্বিক মানবতাবাদ : নজরুল সকল দেশের সকল মানুষের কথা বলেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়,” আমি এদেশে জন্মেছি বলেই শুধু এ দেশেরই, এ সমাজের নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।……………..
৫. প্রতিবাদ : নজরুল বাঙালি দর্শনের অন্যতম প্রতিবাদী দার্শনিক। তাঁর দর্শনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তিনি সকল অন্যায় অবিচার বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
৬. সত্য ও সুন্দরের পূজারি : তিনি ছিলেন সত্য ও সুন্দরের পূজারি। সত্য প্রতিষ্ঠা তার দর্শনের অন্যতম একটি দিক।
৭. অসাম্প্রদায়িক : নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে অনৈক্য দুঃখজনক।
৮. সাম্যবাদ : উপমহাদেশে সাম্যবাদ বা মানবতাবাদের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে নজরুলের কাব্য, গান, উপন্যাস, নাটক ও গদ্যে। তিনি সকল মানুষকে এক মানব সত্তা হিসেবে দেখেছেন।
৯. নারী প্রসঙ্গ : নজরুল নারী শিক্ষা, নারী অধিকার, নারীর সমতা প্রভৃতি বিষয়ে লেখনি ধারণ করেছেন। নারী মুক্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি ইসলাম ধর্মের আদর্শকে মেনে নিয়েছেন।
১০. স্বদেশ ও জাতীয় কল্যাণ : নজরুল স্বদেশ ও জাতীয় কল্যাণ কামনা করেছেন। তাঁর দর্শন কল্যাণধর্মী দর্শন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, প্রগতিশীলতা দ্বারা। তাঁর রচনার মাধ্যমে বাঙালি জাতি উদ্বুদ্ধ হয়েছে মুক্তির সংগ্রামে; রুখে দাঁড়িয়েছে অপশাসনের বিরুদ্ধে। তিনি বিশ্বমানবতাবাদ প্রচার করেছেন। তাঁর দার্শনিক সুলভ চিন্তা বাঙালি দার্শনিকদের জন্য দিক নির্দেশনাস্বরূপ। তাঁর অবদানের জন্য তিনি বাঙালি দর্শনে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন।