বাংলায় সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, বাংলায় সুফিবাদ প্রচারের বিভিন্ন স্তরসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলায় সুফিবাদের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে তোমার অভিমত দাও।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
বাংলা আধ্যাত্মিক সাধনার চারণ ক্ষেত্র। সেই প্রাচীন কাল থেকে বাঙালির মননে আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফূরণ ঘটতে শুরু করে। ক্রমেই তা বাঙালির ঐতিহ্যে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়। সহজিয়া মরমিয়া দর্শন, বাউল দর্শন, বৈষ্ণব দর্শন, যোগ দর্শন, ভক্তিগত সুফিবাদ ইত্যাদি এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
বাংলায় সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার : ইসলামি চিন্তাধারা বা ভাবাদর্শের মরমি দিকটিই সাধারণভাবে সুফিবাদ নামে পরিচিত। ধ্যান অনুধ্যানমূলক সাধনার মাধ্যমে পরম, একক ও অদ্বিতীয় সত্তা মহান আল্লাহর সান্নিধ্য ও সাক্ষাৎ লাভই সুফিবাদের মর্মকথা। সহজসরল বাঙালি মানসে অতি প্রাচীন কালেই অধ্যাত্মবাদ বা মরমি চিন্তার উদ্ভব ঘটলেও বাংলায় কখন কিভাবে সুফিবাদের উদ্ভব ঘটে তার দিনকাল সুনির্দিষ্টভাবে হলফ করে বলা অসম্ভব। মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের পূর্বেই এদেশে সুফিদের আগমন ঘটলেও বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়েই ইসলামি মরমিবাদী চিন্তা বাঙালির মানসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। এ সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সুফি সাধকেরা উল্লেখযোগ্য হারে বাংলায় আসেন এবং এদেশীয়দের মধ্যে ইসলামি ভাবাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। ফলে ইসলামি মরমিবাদী ভাবাদর্শ বাংলায় দ্রুততর সময়ে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। বাংলায় সুফিবাদের এ প্রচার ও প্রসারকালকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা :
প্রথম পর্যায় : বাংলায় মুসলিম বিজয়ের পূর্বে সুফিবাদের যে প্রচার ও প্রসার ঘটে তাকে বাংলায় সুফিবাদ প্রচারের প্রথম পর্যায় বলা যায়। বাংলা মুসলিম বিজয়ের পূর্বেই আরব বণিকদের সঙ্গে এদেশে সুফিদের আগমন ঘটে। নবম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত এসময়ে আরব ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফি ও আলেমগণ বাংলায় আগমন করেন। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আস্তানা গেড়ে তাঁদের প্রচার কার্য পরিচালনা করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলার চট্টগ্রাম জেলা, ময়মনসিংহ জেলার মদনপুর, ঢাকা জেলার বিক্রমপুর ও সোনারগাঁও, পাবনা জেলার শাহজাদপুর, বগুড়া জেলার মহাস্থান, মালদহ জেলার পাড়ুয়া ও দেওকোট এবং বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট প্রভৃতি স্থানে সুফিদের আস্তানা ছিল। এ সময়ে সুফিরা ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সুফিরা নানা স্থানে বাধার সম্মুখীন হন এমনকি কখনোবা তাঁরা শহিদও হয়েছেন। কিন্তু তথাপি তাঁরা তাঁদের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। এ সময় বাংলায় আগত সুফিদের মধ্যে বায়োজিদ বোস্তামী, সৈয়দ শাহ সুরখুল আনতিয়া, শাহ মুহম্মদ সুলতান রুমী, হযরত রেজাশাহ চিশতী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় পর্যায় : বাংলায় সুফিবাদ প্রচার ও প্রসারের দ্বিতীয় পর্যায়ের বিস্তৃতি আনুমানিক ১২০৪ সাল থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ মুসলিম বিজয়ের পর থেকে হালাকু খানের বাগবাদ ধ্বংসের কাল পর্যন্ত। এ সময় মুসলিম শাসিত বাংলায় ধর্মপ্রচারের মহান ব্রত নিয়ে দলে দলে সুফিরা বাংলায় আসেন। অন্যান্য ধীশক্তি ও পুত পবিত্র চরিত্রের অধিকারী মহানুভব এসব সুফিরা খুব সহজেই এদেশের সহজ-সরল মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন। তাঁরা অত্যাচারিত উৎপীড়িত মানুষকে সাহায্য ও পরিত্রাণের আশ্বাস দেন । ফলে এদেশের সাধারণ মানুষ যেমন সহজে সুফিদের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন তেমনি এখানে ইসলাম প্রচারের উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ সময় উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলায় সুফিবাদের প্রসার ঘটে। এসময় বাংলায় আগত সুফিদের মধ্যে মখদুল শাহদৌলা শহীদ, শেখ জালাল উদ্দীন তারবেজী, চিহিল গাজী, দেওয়ান শাহাদাত হোসেন (র), আমীর খান লোহানী, হযরত কুতুব উল আলম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
তৃতীয় পর্যায় : বাংলায় সুফিবাদ প্রচার ও প্রসারের তৃতীয় পর্যায়ের বিস্তৃতি ১২৫৮ সাল থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়কে বাংলায় সুফিবাদ প্রচার ও প্রসারের স্বর্ণযুগ বলা যায়। এ পর্যায়ে প্রথমবারের মতো সুফিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজশক্তির সহায়তা লাভ করে। আর এ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বহিরাগত সুফিরা দলে দলে বাংলায় আসতে শুরু করেন। ফলে সুফিবাদের বাণী ও আদর্শ সমগ্র বাংলায় দ্রুততর সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের অন্তনির্হিত আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলিয়ান সুফিরা রাজ্যানুকূল্য পেয়ে তাঁদের প্রচার কার্যে নতুন শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময়ের সুফিদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সাধারণ জনগণকে সংঘটিত করে অত্যাচারী শোষিত জমিদারদের বিরুদ্ধে এমনকি বৃহৎশক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবার দৃঢ় প্রত্যয়। ফলে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল শ্রেণির
অত্যাচারী মানুষ সুফিদের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। ফলে সুফিবাদ নতুন মহীরূহে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের বাংলার বিখ্যাত সুফিদের মধ্যে শাহ শরীফ জিন্দানী হযরত মীর কুতুব শাহ, শাহজালাল বুখারী, খান জাহান আলী, শাহ ফরিদ, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, হযরত শাহ জালাল ইয়ামনী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সুফিবাদ বাংলায় কোন একক বিশেষ সময়ে বিকাশ লাভ করেনি বরং বিভিন্ন পর্যায়ে নানা দেশ থেকে আগত অসংখ্য সুফিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বদৌলতে সুফি চিন্তা বাংলায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে নেয়।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b2%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%87/