বাংলাদেশের মানবতাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাস আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাদী চিন্তাধারার রূপরেখা বর্ণনা কর ।
অথবা, বাংলাদেশী মানবতাবাদ বলতে কী বুঝ? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কি মানবতাবাদী দার্শনিক বলা যায়?
উত্তর৷। ভূমিকা :
মানুষই তার পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম নৈতিকতা সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রক। তার সৃষ্টি কর্মে অপ্রকৃতির কোনো স্থান নেই। অলৌকিকতার সবটা তার প্রজাতির নিজস্ব এবং লোকায়ত, এটাই মানবতাবাদের মূলকথা। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসকে মানবতাবাদী দর্শনের জনক বলা হয়। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মানুষই সবকিছুর মূল্যায়নের মাপকাঠি (Man is the measure of all things)। আধুনিক যুগেও হবস, লক, রুশো প্রমুখ দার্শনিকও মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহম্মদ (স) মানবতার সপক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষ একই আদমের সন্তান, মানুষ পরস্পর সমান, মানুষ পরস্পর ভাই, সাদাকালো ধনীদরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নেই।” চতুর্দশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর মাধ্যমে পাশ্চাত্য মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটে।
বাংলাদেশে মানবতাবাদ : বাংলাদেশে মানবতাবাদী দর্শন একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাক ঐতিহাসিক কাল পর্যন্ত এর উৎস এদেশে বিস্তৃত। প্রাক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন বাংলার লোকেরা ছিলেন জড়বাদী। জড়বাদী মানবতাবাদের প্রবক্তা হিসেবে এরা ছিলেন মানুষের ইহজাগতিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বিশ্বাসী। তবে এদের এক অংশ ছিলেন অধ্যাত্মবাদী। এরা বাংলাদেশে ধর্মীয় মানবতাবাদের বীজ বপন করেন। বস্তুত প্রাক ঐতিহাসিককাল থেকেই বাংলাদেশে দু’ধরনের মানবতাবাদী চিন্তাধারা বিদ্যমান। একটি হলো সেক্যুলার মানবতাবাদ (Secular Humanism) ও অপরটি হলো নন- সেক্যুলার মানবতাবাদ (Non-secular Humanism)। বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ঘটে গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে । বলা চলে তিনি প্রথম মানবতাবাদ প্রচার করেন। তাঁর বিখ্যাত বাণী “জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।”বাংলাদেশে মানবতাবাদ বিকাশে ইসলাম ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিন্দুরাও মানবতাবাদ প্রচার ও প্রসার করেন। তাঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ও বিবেকানন্দ অন্যতম। ইসলাম ধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ছাড়াও কতকগুলো ধর্মীয় আন্দোলন যেমন— সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদ ও বাউলবাদ বাংলাদেশে মানবতাবাদী চিন্তাধারার প্রকাশ ও বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মানবতাবাদী দার্শনিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, শ্রীচৈতন্য দেব প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
কাজী নজরুল ইসলামের মানবতাবাদ : বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ দর্শনের এক কিংবদন্তী নাম। তিনি এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও বিশ্ব দরবারে এক মহৎ স্থান দখল করে আছেন। নজরুল দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে উপলব্ধি করেছেন সর্বহারা শ্রেণির দুঃখদুর্দশা। তাই তিনি সর্বত্র সর্বহারার জয়গান গেয়েছেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতা, সাহিত্য ও গানে মানবপ্রেমের ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত
মানবতাবাদী মানুষ ।
নিম্নে তাঁর মানবতাবাদের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো :
নজরুলের সার্বিক মানবতাবাদ : নজরুল শুধু কোনো বিশেষ শ্রেণির মানবপ্রেমের কথা বলেননি, তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রেমের কথা বলেছেন। নজরুলকে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা, সামাজিক বন্ধন, এমনকি ধর্মীয় বন্ধনও আটকে রাখতে পারেনি। তাঁর ভাষায়, “আমি এদেশে এ সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এদেশেরই এবং এ সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কেউ বলে আমি মুসলমান, কেউ বলে কাফের, আমি বলি দু’টির কোনোটাই নই। আমি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করার চেষ্টা করেছি।”
নজরুলের বিদ্রোহী মানবতাবাদ : নজরুল ছিলেন একজন বিদ্রোহী মানুষ। তাঁর অনেক লেখায় আমরা খুঁজে পাই তার বিদ্রোহী মানসিকতা। নজরুলের বিদ্রোহ নতুন যুগের মানবতাবোধের সাথে সম্পৃক্ত। মানবসমাজের অবিচার ও অসাম্য থেকে শুরু করে স্রষ্টার নিরঙ্কুশ শাসনাধিপত্য পর্যন্ত তাঁর বিদ্রোহের সীমা বিস্তৃত। নজরুল বলেছেন,
“জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক
জাগো শ্রমিক, জাগো নারী।”
নজরুল নিজেই বলেছেন, আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি,অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বিদ্রোহের মাধ্যমে মানুষের সর্বাত্মক মুক্তি চান। শ্রমিক, কৃষক, সর্বহারা মানুষকে তিনি দিতে চেয়েছিলেন অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষার অধিকার।
নজরুলের ধর্মীয় মানবতাবাদ : নজরুল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সকল ধর্মের, সকল মানুষের মুক্তির দিশারি। নজরুল ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে তাঁর মানবীয় সত্তাকে বলি দেননি। তবে নজরুল একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই তাঁর ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বিচরণ করেছেন। তাঁর লেখনিতে তিনি প্রথমে মানুষ, তারপর মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে মত দেন। তিনি ধর্মের নৈতিক দিক যা সর্বজনীন মানবতাবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, তারই উপাসক। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়
কে দেয় সেখানে তালা
চালা হাতুড়ি শাবল চালা।”
তাইতো বলা যায়, তিনি কোন শ্রেণির নয়; তিনি সকল মানুষের।
নজরুলের সামাজিক মানবতাবাদ : মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তাই মানুষের সমাজ প্রয়োজন। কিন্তু এ সমাজে দু’টি শ্রেণি রয়েছে। যথা: ১. উচ্চবিত্ত শ্রেণি ও ২, নিম্নবিত্ত শ্রেণি। উচ্চবিত্ত শ্রেণি নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে শোষণ ও নির্যাতন করে। নজরুল এ শোষিত নিম্নশ্রেণির পাশে দাঁড়িয়েছেন। শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। নজরুলের অনেক কবিতা ও গানে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ প্রভৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চিত্র ফুটে উঠেছে। নজরুলের অগ্নিবীণার অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো একাধারে যেমন শোষক শ্রেণির অন্তরকে কাঁপিয়ে তুলেছে, অন্যদিকে নির্যাতিত শোষিত শ্রেণিকে উজ্জীবিত করেছে। নজরুলের এ বাণী থেকে বুঝা যায়, তিনি ছিলেন শোষিত শ্রেণির বন্ধু। সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার নির্লজ্জ নখরাঘাতে সারা বিশ্বের অসহায় মানবাত্মার আহাজারিতে পৃথিবীর বাতাস ভারী হয়েছে, মানবতাবোধ লাঞ্ছিত হয়েছে। নজরুল এ আধিপত্যবাদ, আগ্রাসনবাদের প্রাচীর ভেঙে মানবতার পথকে সুদৃঢ় আসনে বসাতে চেষ্টা করেছেন। এ নশ্বর বিশ্বের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম পুঁজিবাদী শ্রেণির কালো হাতকে প্রতিহত করার জন্য এ জনগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়ে গেছেন অধিকার আদায়ের ভাষা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, সারা বিশ্ব যখন মানবাধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করছে, তখন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান, উপন্যাসগুলোর দার্শনিক মূল্য নির্ধারণ করা হলে প্রমাণিত হবে যে, মানবতাবাদী দার্শনিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। নজরুলের লেখনিগুলো ছিল মানুষের দাবি আদায়ের বিপ্লবী স্লোগান। তিনি পুঁজিবাদী শ্রেণির হাত থেকে সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করে গেছেন। তাই তাঁকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবেও চিনি। তিনি তাঁর মানবতাবাদী রচনার জন্য অমর হয়ে আছেন বাংলার ঘরে ঘরে।