বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আর্থসামাজিক কারণগুলো আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আর্থসামাজিক কারণগুলো কী কী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্বে সকল দেশের জন্যই বহুল আলোচিত বিষয় এবং সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমস্যা। বিশ্বের জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উন্নত দেশ অপেক্ষা উন্নয়নশীল দেশগুলো এই সমস্যার ভারে অধিক জর্জরিত।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আর্থসামাজিক কারণসমূহ : জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো একক কারণ নেই। বহুবিধ কারণের ফলেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আর্থসামাজিক কারণসমূহ নিম্নে উল্লেখ
হলো :
১. যে সকল সামাজিক কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে বাল্য বিবাহ তাদের মধ্যে একটি। বাংলাদেশে আজও বিবাহের বয়স অত্যন্ত কম। সাধারণত প্রজনন হার ১৫ থেকে ৪৯ বয়স্ক মহিলাদের উপর নির্ভর করে।
অল্প বয়সে বিয়ে হলে স্বাভাবিকভাবেই অধিক সন্তান উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, যেহেতু এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েদের বিবাহ হয়ে যায়, সেহেতু জন্মহার বৃদ্ধি পায়। কারণ বিয়ের পর পরই দম্পতি সন্তানের প্রত্যাশা করে।
২. বহু বিবাহ : বহু বিবাহ জনসংখ্যা বৃদ্ধির অপর একটি সামাজিক কারণ। বহু বিবাহের ফলে একজন লোকের সন্তান সংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায় ।
৩. স্ত্রী শিক্ষা : পৃথিবীব্যাপী দেখা গিয়েছে যে মেয়েদের শিক্ষা যত বেশি তাদের সন্তান সংখ্যাও তত কম হয়। কারণ স্বরূপ বলা যায় যে-
ক. যে সকল মহিলা অধিক শিক্ষিত তাদের পড়াশুনায় অধিক সময় ব্যয় হওয়ার ফলে বিবাহের বয়সও অধিক হয়।
খ. শিক্ষিতা মহিলাগণ চাকরি বা সংসারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে সহায়তা করে বলে সংসার কর্মের বাইরেও তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে তারা কম সন্তান কামনা করেন।
গ. শিক্ষিত মহিলাগণ সাধারণত পরিবারের সুখ-সুবিধা এবং সন্তান সংখ্যা সম্বন্ধে সচেতন হয়।
৪. কর্মসংস্থান : উন্নত দেশের শ্রম শক্তির অর্ধেক সংখ্যাই মহিলা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং জাপানের মত দেশে ৪৫ ভাগ মহিলা উপার্জনক্ষম। এ সকল দেশে মহিলাদের শতকরা ৯৯ ভাগ শিক্ষিতা এবং তাদের প্রজনন হার গড়ে শতকরা ১। বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে মহিলার হার শতকরা ১০ থেকে ১৫। এখানে শিক্ষিতা মহিলার হার অনেক কম। গ্রামীণ এলাকাতে আরো কম। আত্মরক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাব হেতু মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা অত্যন্ত কম। তাদের অবদান বা তাদের দায়িত্ব গৃহের চার দেয়ালে এবং সন্তান উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ।
৫. সামাজিক গঠন : বাংলাদেশ মূলত গ্রামপ্রধান দেশ। এখানকার সমাজ ব্যবস্থায় সন্তান, বিশেষ করে পুত্র সন্তান পরিবারের একটি মূল্যবান সম্পদ। সেজন্য কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানের সংখ্যা অধিক। সমাজে চলতি অন্ধ বিশ্বাস, গতানুগতিক মূল্যবোধ এবং কুসংস্কারও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। জনসংখ্যা পরিকল্পনা বহুলাংশে মানুষের জ্ঞান ও উপলব্ধির উপর নির্ভর করে এ কথা অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না।
৬. পুরুষশাসিত সমাজ : পুরুষশাসিত সমাজকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ বাংলাদেশে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। পুরুষ তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অধিক সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করে।
৭. দারিদ্র্য ও অভাব : দারিদ্র্য ও অভাব জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামাজিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত। কারণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যানুযায়ী ক্ষুধা পেটে মানুষের যৌন চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সে স্ত্রীর সাথে সহবাসে মিলিত হয় এবং সন্তান জন্ম দেয়। তাই দারিদ্র ্য ও অভাব পরোক্ষভাবে সন্তান বা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
৮. কৃষিভিত্তিক যৌথ পরিবার : বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের কৃষিভিত্তিক যৌথ পরিবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। যেমন- একজন চাষি তার জমি চাষাবাদের জন্য অধিক সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হয়। কারণ জমি চাষে অধিক সন্তান থাকলে বাইরে থেকে কৃষি শ্রমিক নিতে হয় না। তাই এ ধরনের মনমানসিকতার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
অতি সহজে।
৯. জীবন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব : মানবজীবন সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত। কারণ গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত জনগণের মাঝে জীবনযাত্রার উন্নত মান সম্পর্কে সচেতনতা দেখা যায় না। তারা সুদূরপ্রসারী চিন্তা না করে অধিক সন্তান নিতে উৎসাহ বোধ করে।
১০. পুত্র সন্তান প্রত্যাশা : পুত্র সন্তান ভবিষ্যৎ জীবনে বাবা-মাকে দেখবে আর নারী সন্তান বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। এ ধরনের মনমানসিকতা প্রত্যেক দম্পতিকে পুত্র সন্তান জন্মদানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ফলে একটি দম্পতি একাধিক কন্যা সন্তান জন্মদানের পর পুত্রসন্তানের প্রত্যাশায় আরো বেশি সংখ্যক সন্তান জন্মদান করে। ফলে
জনসংখ্যা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় ।
১১. পরিবার পরিকল্পনার সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাব : পরিবার পরিকল্পনার সুষ্ঠু ব্যবহারের অভাবও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। কারণ দেখা যায় অসচেতন জনগণকে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারের উপকারিতা বুঝানোর জন্য যে পরিমাণ প্রশিক্ষণ ও উপকরণের প্রয়োজন হয় তা সরকারের একার পক্ষে যোগান দেয়া দুরূহ। ফলে দেখা যায় অসচেতন জনগণ পরিবার পরিকল্পনার যথার্থতা বুঝতে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণ সমূহের মধ্যে আর্থসামাজিক কারণগুলো অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে রোধ করতে পারে।