পূর্বানুমানের উৎস উল্লেখপূর্বক একটি নির্ভরযােগ্য পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্য আলােচনা কর।

অথবা, একটি পূর্বানুমানের গুণাগুণ বিচারের জন্য কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন আলোচনা কর।
অথবা, একটি নির্ভরযোগ্য অনুকল্পের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, একটি হাইপোথেসিসের গুণাগুণ বিচারের জন্য কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন আলোচনা কর। এর উৎসগুলো ব্যাখ্যা কর।

উত্তরা ভূমিকা : গবেষণা সমস্যা প্রণয়নের পরই গবেষককে উপস্থাপিত প্রশ্নসমূহের আলোকে সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করতে হয়। এগুলোকে পূর্বঘোষণাও বলা যায়, যার ভিত্তি হতে পারে গবেষণা সংশ্লিষ্ট জানা তথ্য, গবেষণাকর্ম, বা রচনাসমূহ। প্রকৃতপক্ষে ভালো প্রকল্প বা অনুকল্প বা অনুসিদ্ধান্ত প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট রচনাসমূহের ব্যাপক পর্যালোচনা প্রয়োজন হতে পারে। সে অবস্থায় রচনা পর্যালোচনার পর তা প্রণয়ন করতে দেখা যায়। অনুসিদ্ধান্ত বা প্রকল্প প্রণয়নের মধ্য দিয়ে গবেষক তার প্রণীত সমস্যা প্রসঙ্গে এমন কিছু সমাধানমূলক অভীষ্মা ব্যক্ত করেন যা তার গবেষণার দ্বারা অর্জি তথ্যের মাধ্যমের যাচাই করা যায়। এখানে একটি উত্তম প্রকল্পের বৈশিষ্ট্যাবলি এবং সামাজিক গবেষণায় প্রকল্পের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।


পূর্বানুমালের উৎস : নিম্নে পূর্বানুমানের উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. গবেষকের গঠনমূলক চিন্তা’ পূর্বানুমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে বেশি। এ অনুমান নিয়ে প্রথমে ম্যালথাস গবেষণা শুরু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে এটিই বিখ্যাত জনসংখ্যাতত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বলা যায়, সমস্যা সম্পর্কে গবেষকের যদি পর্যাপ্ত সাধারণ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে ভালো পূর্বানুমান প্রণয়ন সম্ভব নয়।


২. বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূর্বানুমানের উৎস হলো তত্ত্ব। যেমন- সামাজিক সংহতি তীব্র চাপ ও উদ্বেগের প্রশমনের জন্য মানসিক সমর্থন পান করে এবং আত্মহত্যা হলো তীব্র চাপ ও মানসিক উদ্বেগের পরিণতি। এ তত্ত্বটি যাচাই করার জন্য নিম্নলিখিত পূর্বানুমান প্রণয়ন করা যায়। যেমন- যেহেতু ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সামাজিক সংহতি প্রোটেন্ট্যান্টদের তুলনায় কম, সেহেতু প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে ক্যাথলিকদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি হবে। যদি প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত করে দেখা যায় পূর্বানুমানটি সত্য হয়েছে তাহলে তত্ত্বটির সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর পূর্বানুমানটি সত্য না হলে তত্ত্বটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিবে। এ প্রসঙ্গে রবার্ট ডুবিন বলেন যে, “তত্ত্ব হলো পর্যবেক্ষণীয় ঘটনাবলির সম্পর্কের একটি মডেল বা পরিকল্পনা এবং পূর্বানুমান এ মডেলের
একটি নিকটতম প্রতিরূপ।”

৩. অনেক সময় ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা থেকেই পূর্বানুমানের সূচনা হয়। বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে পূর্বানুমান গঠন করতে হলে বিজ্ঞানীর প্রখর অন্তর্দৃষ্টি এবং উদ্ভাবনী শক্তির দরকার। একই ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করে। সেগুলোকে একজন সাধারণ মানুষ শুধু এলোমেলো ঘটনা ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞানী তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রশিক্ষণের জন্য এসব ঘটনার মধ্যেও পারস্পরিক সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারেন। বিজ্ঞানীর মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়, সাধারণ মানুষের মনে সেসব প্রশ্নের উদয় হয় না।

৪. কোন কোন সময় পূর্ববর্তী গবেষণার ফলাফল পূর্বানুমানের উৎস হতে পারে। অন্য কোন দেশের বা অন্য কোন স্থানের গবেষণার ফলাফলের উপরে ভিত্তি করে গবেষক পূর্বানুমান প্রণয়ন করতে পারেন যে, ডক্ত গবেষণায় বিভিন্ন চলকের মধ্যে যে সম্পর্ক দেখা গেছে বর্তমান গবেষণায়ও সে ধরনের সম্পর্ক দেখা যাবে। বহু গবেষক ইতোপপূর্ব পরিচালিত গবেষণার পুনরুৎপাদন (Replication) করে থাকেন এবং ভিন্ন পরিস্থিতিতে উক্ত গবেষণার ফলাফলের সত্যতা যাচাই করে দেখেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন গবেষক তার ফলাফলে দ খালেন যে, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিরা বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে সহজে গ্রহণ করে। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একটি নতুন গবেষণার জন্য পূর্বানুমান প্রণয়ন করা যায় যে, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিরা পরিবার পরিকল্পনার প্রতি বেশি আগ্রহী হবে।

৫. অনেক সময় সাদৃশ্যপূর্ণতা পূর্বানুমানের উৎস হতে পারে। যদিও সাদৃশ্য যুক্তি অনেক সময় ভ্রান্ত হতে পারে; তা সত্ত্বেও জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনা থেকে সমাজবিজ্ঞানের পূর্বানুমান তৈরি হতে পারে। যেমন- সাইবারনেটিক বিজ্ঞান থেকে ধারণা গ্রহণ করে সমাজবিজ্ঞানীরা যোগাযোগের মডেল বা নকশা প্রণয়ন করেছেন। ঠিক তেমনিভাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান থেকে ধারণা গ্রহণ করে মনোবিজ্ঞানীরা স্মৃতির তথ্য প্রক্রিয়া বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে পূর্বানুমান প্রণয়ন করেছেন। মনোবিজ্ঞানী কার্ট লিউন (Kurt Lewn) ব্যক্তিত্বের গতিশীলতা ব্যবহার করতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ভেক্টর (Vector) তত্ত্বের ধারণা ব্যবহার করেছেন। এভাবে বিজ্ঞানীরা কোন ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার জন্য অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে সদৃশ ধারণাকে তাদের পূর্বানুমান গঠনের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।

৬. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকেও অনেক সময় গবেষণায় পূর্বানুমানের উৎস হিসেবে শনাক্ত করা যায়। কোন কোন সমাজের মূল্যবোধ কতকগুলো সামাজিক সমস্যার প্রতি বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে। সুতরাং এসব মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ফলে কতকগুলো বিশেষ পূর্বানুমানের প্রতি
বিজ্ঞানীরা আকৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান সমাজের সুখবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীরা আর্থিক আয়, শিক্ষা, সামাজিক শ্রেণি ইত্যাদির চলকের সাথে ব্যক্তিগত সুখানুভূতির সম্পর্ক আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন।

৭. বাস্তব জগতে কাজকর্ম করতে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকের সাথে
লাপকালে কোন একটি বিশেষ বিষয়ে একজন গবেষকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে পারে এবং তা থেকেও পূর্বানুমান সৃষ্টি হতে পারে। একটি পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্য বা একটি পূর্বানুমানের গুণাগুণ বিচারের জন্য প্রয়োজনীয়

বৈশিষ্ট্যাবলি : একটি পূর্বানুমানের গুণাগুণ বিচারের জন্য অনেকগুলো গুরুত্ব ও অত্যাবশ্যাকীয় বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখতে হয় । এগুলোকে একটি ন র্ভরযোগ্য পূর্বানুমানের বৈশিষ্ট্য বা স্বরূপও বলা হয়ে থাকে। নিম্নে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :

১. সুনির্দিষ্ট : একটি পূর্বানুমান বা প্রকল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদানের জন্য এটিকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হতে হবে এবং প্রকল্পে ব্যবহৃত ধারণাগুলোর মধ্যে নির্দিষ্টতা ও সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকতে হবে।


২. প্রমাণ সাপেক্ষ : প্রকল্প বা পূর্বানুমানের সাহায্যে যাতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর এজন্য একটি উত্তম প্রকল্প অবশ্যই প্রমাণ সাপেক্ষ হবে। কেননা, বাস্তবতার সাথে বাস্তব তত্ত্বের সাথে পূর্বানুমানের কোনো সম্পর্ক না থাকলে সে পূর্বানুমানের কোনো মূল্য থাকে না ।

৩. যুক্তিভিত্তিক : একটি উত্তম পূর্বানুমান বা প্রকল্পকে যুক্তিভিত্তিক হবে হবে। যেমন-দুটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হলে এর মধ্যে একটি প্রকল্প নিজেই তার সমস্যা সমাধান করতে পারে। কিন্তু অন্যটি নিজেই নিজের সমস্যা সমাধান না করে বাড়তি অনুমানের সাহায্য গ্রহণ করে। কাজেই প্রথম প্রকল্পটিকে এক্ষেত্রে উত্তম বলে বিবেচনা করা হবে।


৪, তাত্ত্বিক ভিত্তি : গবেষণার জন্য প্রকল্প বা পূর্বানুমানের তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকতে হবে। কেননা, প্রকল্পকে প্রমাণ করার জন্য প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে থাকে। তাই প্রকল্পের ভিত্তি তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় একটি প্রকল্প প্রণয়ন করার লক্ষ্য হলো প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সমর্থনে প্রমাণ উপস্থিত করা।
৫. পরীক্ষণযোগ্য : একটি পূর্বানুমানকে উত্তম পূর্বানুমান বা প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হবে তখনই যখন এটির সত্যতা যাচাই বা পরীক্ষা করা যাবে। এ ধরনের শুধু প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকেই ব্যাখ্যা করা না গেলে এবং অজানা ইত্যাদি ঘটনাবলি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। বস্তুত কোনো প্রকল্পের যাচাই যোগ্যতা বা একটিকে পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে না পারলে এটিকে উত্তম প্রকল্প বা উত্তম পূর্বানুমান বলা যায় না।

৬. সংখ্যায় প্রকাশ করা পূর্বানুমানের চলকসমূহের সম্পর্ক সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে এগুলোকে সংখ্যায় বা সংখ্যামানে প্রকাশ করা যায়। অর্থাৎ, প্রকল্পটি যাতে সংখ্যায় প্রকাশ করা যায়, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। তখনই এটিকে উত্তম প্রকল্প বলে বিবেচনা করা যাবে।


উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বস্তুত প্রকল্প একটি অস্থায়ী প্রস্তাবনা, যার যথার্থতা ও সত্যতা পরীক্ষা নিরীক্ষা সাপেক্ষ। অনুকল্প বা প্রকল্প ছাড়া উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রকল্পভিত্তিক উপাত্ত সংগ্রহের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্যের অপ্রতুলতা স্বীকার করে নিচ্ছি এবং অনুপ্রকল্পের ক্ষেত্রে সীমিত করার মাধ্যমে তাদের ভ্রান্তিকে কমানোর চেষ্টা করি। সর্বোপরি প্রকল্প গবেষণার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ, যার ভূমিকা গবেষণা সম্পাদনে সর্বাধিক বলা যায়।