তরাইনের যুদ্ধ

তরাইনের যুদ্ধ ১১৯১ ও ১১৯২ সালে বর্তমান হরিয়ানার থানেশ্বরের নিকটে তরাইন নামক শহরের নিকটে সংঘটিত হয়। এই স্থান দিল্লি থেকে ১৫০ কিলোমিটার (৯৩ মা) উত্তরে অবস্থিত। মুহাম্মদ ঘুরির নেতৃত্বাধীন ঘুরি বাহিনী ও পৃথ্বীরাজ চৌহানের নেতৃত্বে চৌহান রাজপুত বাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়।

তরাইনের যুদ্ধ ১১৯১ সাল থেকে ১১৯২ সালে বর্তমান হরিয়ানার থানেশ্বরের নিকটে তরাইন নামক শহরের নিকটে সংঘটিত হয়েছিল। এই স্থান দিল্লি থেকে ১৫০ কিলোমিটার বা ৯৩ মাইল উত্তরে অবস্থিত। মুহাম্মদ ঘুরির নেতৃত্বাধীন ঘুরি বাহিনী এবং পৃথ্বীরাজ চৌহানের নেতৃত্বে চৌহান রাজপুত বাহিনীর মধ্যে সেই যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়।মুহাম্মদ ঘুরি ১১৯১ সালে পাঞ্জাবের ভাটিন্ডা দুর্গ জয় করেন। সেই স্থান ছিল পৃথ্বীরাজ চৌহানের সীমান্ত এলাকা ছিল। পৃথ্বীরাজ ভাটিন্ডার দিকে অগ্রসর হয়ে তরাইন নামক স্থানে থানেশ্বরের নিকটে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হন। ঘুরি বাহিনীর অশ্বারোহীদের প্রতিপক্ষের মধ্যভাগের দিকে তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। পৃথ্বীরাজের বাহিনী তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধে আধিপত্য স্থাপন করেন। ফলে ঘুরিরা পিছিয়ে যায়। পৃথ্বীরাজের ভাই গোবিন্দ তাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত লড়াইয়ে মুহাম্মদ ঘুরি আহত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ঘুরিদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন।গজনি ফিরে আসার পর মুহাম্মদ ঘুরি পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। লাহোর পৌছার পর তিনি পৃথ্বীরাজের কাছে আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে দূত পাঠান। পৃথ্বীরাজ এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। পৃথ্বীরাজ এরপর অন্যান্য রাজপুত নেতাদেরকে তার পাশে দাড়নোর আহ্বান জানান।ইতিহাসবিদ ফিরিশতার মতে রাজপুত বাহিনীতে ৩,০০০ হাতি, ৩,০০,০০০ অশ্বারোহী এবং পদাতিক সৈনিক ছিল। তবে এই সংখ্যা সঠিক সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি মনে করা হয়।মিনহাজ-ই-সিরাজ লিখেছেন যে মুহাম্মদ ঘুরির বাহিনীতে ১,২০,০০০ সশস্ত্র সৈনিক ছিল।

মিত্ররা এসে উপস্থিত না হওয়ায় পৃথ্বীরাজ আরো কিছু সময় আশা করছিলেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর মুহাম্মদ ঘুরি সন্ধি প্রস্তাব দিয়ে পৃথ্বিরাজকে চিঠি পাঠান। ভোর শুরু হওয়ার পূর্বে ঘুরি বাহিনী রাজপুতদের উপর আক্রমণ শুরু করে। মুহাম্মদ ঘুরি তার বাহিনীকে পাঁচটি ইউনিটে বিভক্ত করেন। চারটি ইউনিট রাজপুত বাহিনীর পার্শ্বভাগ এবং পশ্চাতভাগ আক্রমণ করে।তার পার্শ্বভাগের আক্রমণগুলো ব্যর্থ হয় তবে লড়াই চলতে থাকে।রাজপুতদের সারি ভেঙে ফেলার জন্য মুহাম্মদ ঘুরি তার পঞ্চম ইউনিটকে পালানোর ভান করার আদেশ দেন।রাজপুতরা পিছু হটা ইউনিটকে আক্রমণ করে। তার ফলে পৃথ্বীরাজের বাহিনীর স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়।এমনসময় পার্শ্বভাগের আক্রমণের পাশাপাশি ঘুরিদের ১২,০০০ অশ্বারোহী আক্রমণ শুরু করে। তার ফলে রাজপুতরা পরাজিত হয়। পৃথ্বীরাজকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

প্রথম যুদ্ধ
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ তারিখ ১১৯১ অবস্থান থানেশ্বরের নিকটে ফলাফল চৌহান রাজপুতদের বিজয় অধিকৃত এলাকার পরিবর্তন পৃথ্বীরাজ ভাটিন্ডার দুর্গ পুনরায় অধিকার করেন বিবাদমান পক্ষ ঘুরি সাম্রাজ্য চৌহান রাজপুত সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী মুহাম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজ চৌহান শক্তি অজ্ঞাত দুই লক্ষ অশ্বারোহী ও তিন হাজার হস্তী বাহিনী মুহাম্মদ ঘুরি ১১৯১ সালে পাঞ্জাবের ভাটিন্ডা দুর্গ জয় করেন। এই স্থান ছিল পৃথ্বীরাজ চৌহানের সীমান্ত এলাকা। পৃথ্বীরাজ ভাটিন্ডার দিকে অগ্রসর হয়ে তরাইন নামক স্থানে থানেশ্বরের নিকটে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হন। ঘুরি বাহিনীর অশ্বারোহীদের প্রতিপক্ষের মধ্যভাগের দিকে তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। পৃথ্বীরাজের বাহিনী তিন দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ করে এবং যুদ্ধে আধিপত্য স্থাপন করে। ফলে ঘুরিরা পিছিয়ে যায়। পৃথ্বীরাজের ভাই গোবিন্দ তাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত লড়াইয়ে মুহাম্মদ ঘুরি আহত হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ঘুরিদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন।

দ্বিতীয় যুদ্ধ
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ তারিখ ১১৯২ অবস্থান থানেশ্বরের নিকটে ফলাফল ঘুরিদের বিজয় অধিকৃত এলাকার পরিবর্তন মুহাম্মদ ঘুরি বিহার প্রদেশ জয় করেন বিবাদমান পক্ষ ঘুরি সাম্রাজ্য চৌহান রাজপুত সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী মুহাম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজ চৌহান শক্তি ১,২০,০০০ ৩,০০,০০০ হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
পৃথ্বীরাজ চৌহান(মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত) গজনি ফিরে আসার পর মুহাম্মদ ঘুরি পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। লাহোর পৌছার পর তিনি পৃথ্বীরাজের কাছে আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে দূত পাঠান। পৃথ্বীরাজ এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। পৃথ্বীরাজ এরপর অন্যান্য রাজপুত নেতাদেরকে তার পাশে দাড়নোর আহ্বান জানান। সেনা সংখ্যা ইতিহাসবিদ ফিরিশতার মতে রাজপুত বাহিনীতে ৩,০০০ হাতি, ৩,০০,০০০ অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈনিক ছিল। তবে এই সংখ্যা সঠিক সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি মনে করা হয়। মিনহাজ-ই-সিরাজ লিখেছেন যে মুহাম্মদ ঘুরির বাহিনীতে ১,২০,০০০ সশস্ত্র সৈনিক ছিল।

তৃতীয় যুদ্ধ
মিত্ররা এসে উপস্থিত না হওয়ায় পৃথ্বীরাজ আরো কিছু সময় আশা করছিলেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর মুহাম্মদ ঘুরি সন্ধি প্রস্তাব দিয়ে পৃথ্বিরাজকে চিঠি পাঠান। ভোর শুরু হওয়ার পূর্বে ঘুরি বাহিনী রাজপুতদের উপর আক্রমণ শুরু করে। মুহাম্মদ ঘুরি তার বাহিনীকে পাঁচটি ইউনিটে বিভক্ত করেন। চারটি ইউনিট রাজপুত বাহিনীর পার্শ্বভাগ ও পশ্চাতভাগ আক্রমণ করে। তার পার্শ্বভাগের আক্রমণগুলো ব্যর্থ হয় তবে লড়াই চলতে থাকে। রাজপুতদের সারি ভেঙে ফেলার জন্য মুহাম্মদ ঘুরি তার পঞ্চম ইউনিটকে পালানোর ভান করার আদেশ দেন। রাজপুতরা পিছু হটা ইউনিটকে আক্রমণ করে। এর ফলে পৃথ্বীরাজের বাহিনীর স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়।[১] এসময় পার্শ্বভাগের আক্রমণের পাশাপাশি ঘুরিদের ১২,০০০ অশ্বারোহী আক্রমণ শুরু করে। এর ফলে রাজপুতরা পরাজিত হয়। পৃথ্বীরাজকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

পরবর্তী অবস্থা
মুহাম্মদ ঘুরির এই বিজয় ফলাফল নির্ধা‌রণী ছিল। ১১৯৩ সালে তিনি বিহার প্রদেশ জয় করে নেন। ১২০৪ সালে তার বাহিনী বাংলা জয় করে ভারত বিজয় সম্পন্ন করে

তরাইনের যুদ্ধ!
মুহাম্মদ ঘুরি ও পৃথ্বীরাজ চৌহানের যে যুদ্ধ ভারতবর্ষে সূচনা করেছিল ইসলামি শাসন!


ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুহাম্মদ ঘুরি ও পৃথ্বীরাজ চৌহানের তরাইনের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে ইসলামি শাসনের সূচনা হয়।
তরাইনে ঘুরি ও পৃথ্বীরাজ দুটি যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এগুলো তরাইনের প্রথম ও ২য় যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১ম যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেও দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি পৃথ্বীরাজকে পরাস্ত ও হত্যা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বলিউড এই যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একটি ছবি নির্মিত হচ্ছে আশাকরি অতীতের মত এবারও একটি বিকৃত ইতিহাস দেখতে পাব বলিউডের কল্যাণে!

তরাইনের যুদ্ধের কারণঃ


বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের কনৌজের রাজা ছিলেন রাজপুত বংশোদ্ভুত জয়চন্দ্র। রাজা জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তাকে পছন্দ করতেন আরেক রাজপুত রাজা বীর পৃথ্বীরাজ চৌহান। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু রাজা জয়চন্দ্র এই প্রস্তাব মেনে না নিলে পৃথ্বিরাজ সংযুক্তাকে অপহরণ করেন। কন্যাকে ফিরে পাওয়ার আশায় এবং
পৃথ্বীরাজের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ক্ষুব্ধ রাজা জয়চন্দ্র মুহাম্মদ ঘুরিকে আমন্ত্রণ জানান হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে!
রাজা জয়চন্দ্রের আহ্বানে, ১১৯১ সালে শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরি আর দেরি না করে হিন্দুস্তানের দিকে রওয়ানা দেন।
খাইবার গিরিপথের মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে তিনি পাঞ্জাবে এসে পৌঁছান। পাঞ্জাবের বাথিন্ডায় পৃথ্বীরাজের একটি দুর্গ ছিলো। মুহাম্মদ ঘুরি বাথিন্ডার এই দুর্গটি দখল করে নেন।

তরাইনের প্রথম যুদ্ধঃ-


দুর্গ দখলের সংবাদে পৃথ্বীরাজ তাঁর ভাইপো গোবিন্দ তাইকে নিয়ে মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
তাঁর সাথে ২০ হাজার অশ্বারোহী সহ প্রায় ৫০ হাজারের বিশাল এক সেনাবাহিনী। মুহাম্মদ ঘুরির সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের দেখা হলো হরিয়ানার থানেশ্বরের তরাইন গ্রামে।
মুহাম্মদ ঘুরির সাথে ছিল অশ্বারোহী আর পদাতিক মিলে প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য। পৃথ্বীরাজ চৌহান বিজয়ের ব্যাপারে তাই কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে উঠলেন।
আসলে যুদ্ধে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয় যুদ্ধ শুরুর আগেই। মুহাম্মদ ঘুরি প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজিত হয়ে বসে ছিলেন। কারণ, তিনি তাঁর বাহিনীকে রাজপুতদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। বাহিনীর বিন্যাসও ছিলো সেরকমই।
অথচ, তাঁর বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন তুর্কী। এসব যোদ্ধারা সম্মুখ লড়াইয়ের পরিবর্তে তুর্কী বিশেষ কৌশলে যুদ্ধ করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। প্রতিপক্ষের তীব্র আক্রমণের সময় তুর্কী যোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ভান ধরতেন। প্রতিপক্ষ পলায়নপর যোদ্ধাদের তাড়া করতেন। ঠিক এই সময়টির জন্য তুর্কী যোদ্ধারা অপেক্ষা করতেন। তারা পলায়নপর ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টো হয়ে প্রতিপক্ষের দিকে তীর ছুঁড়তেন। তুর্কী যোদ্ধাদের এই কৌশলটি পরীক্ষিত। তাঁদের এই কৌশলটি খুব কমই ব্যর্থ হতো।
আর মুহাম্মদ ঘুরি ঠিক এই জায়গাটিতেই ভুল করেছিলেন। তিনি তুর্কী সৈন্যদের তাঁদের নিজস্ব রীতিতে লড়াই করতে না দিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে পাঠান।
ফলে এই অনভ্যস্ত রীতিতে ঘুরি সেনাবাহিনীর তুর্কী যোদ্ধারা খুব সহজের কাবু হয়ে যান। রাজপুতদের তীব্র তীরবৃষ্টি আর সম্মুখ আক্রমণে ঘুরির বাহিনী খুব সহজেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুহাম্মদ ঘুরি নিজেও যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন।
তরাইনের এই যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরির বেশিরভাগ সৈন্যই নিহত হন। যারা জীবিত ছিলেন তাঁদের অবস্থাও বেশ নাজুক ছিলো। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে কোনোমতে তারা আফগানিস্থান ফিরে যান।
পৃথ্বীরাজ চৌহানের গৌরবদীপ্ত বিজয় আর মুহাম্মদ ঘুরির শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমেই শেষ হয় তরাইনের প্রথম যুদ্ধটি। পৃথ্বীরাজ চৌহান তাঁর নিজ দেশে পান বীরের মর্যাদা।

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধঃ


তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের বীজ লুকিয়ে ছিলো তরাইনের প্রথম যুদ্ধেই।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধের পরের বছর, অর্থাৎ, ১১৯২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো পৃথ্বীরাজ চৌহানের মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন মুহাম্মদ ঘুরি। এ সময় মুহাম্মদ ঘুরির সাথে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বিশাল এক সেনাবাহিনী ছিলো।
মুহাম্মদ ঘুরির অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহানও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
পৃথ্বীরাজের সহায়তায় প্রায় ১৫০ জন রাজপুত রাজা এগিয়ে আসেন। আশেপাশের রাজ্যের সাহায্য পেয়ে পৃথ্বীরাজ বিশাল এক সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন।
ঐতিহাসিক ফারিস্তার বর্ণনায় জানা যায়, পৃথ্বীরাজের বাহিনীতে হাতিই ছিলো ৩,০০০ এর বেশি। আর অশ্বারোহীসহ সেনাবাহিনীর আকার দাঁড়ায় ৩ লাখে!
যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে উভয় পক্ষই প্রথমে কূটনৈতিক আলোচনার চেষ্টা করে। রাজপুতরা আসলে আরো কিছুটা সময় আদায় করতে চাইছিলো। রাজপুত উদয়রাজ তখনো যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছাতে পারেন নি। অন্যদিকে মুহাম্মদ ঘুরি নিজেকে কিছুটা দুর্বল হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলেন, যাতে রাজপুতরা আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। মুহাম্মদ ঘুরি এক্ষেত্রে বেশ সফল হয়েছিলেন, কারণ রাজপুত বাহিনীর ভেতরে বেশ ঢিলেঢালা ভাব এসে পরেছিলো।
মুহাম্মদ ঘুরি এই মুহূর্তটির অপেক্ষাতেই ছিলেন।
যুদ্ধের শুরুতে তিনি চারপাশ থেকে রাজপুত সেনাবাহিনীকে ঘিরে তীর বৃষ্টি চালালেন। তবে রাজপুত সেনাবাহিনীর আকার ছিলো আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। আর আকারের এই বিশালতার কারণে খুব সহজেই রাজপুত সেনারা নিজেদের সামলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
দ্রুতই রাজপুত সেনাবাহিনী মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীকে তীব্র বাঁধা প্রদান করেন।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরি যে ভুলটি করেছিলেন, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি আর তার পুনরাবৃত্তি করলেন না। তিনি তার সেনাবাহিনীর তুর্কী ইউনিটটিকে তাঁদের নিজস্ব রীতিতে যুদ্ধ করতে দেন। তুর্কী যোদ্ধারাও নিজেদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন।
রাজপুত সেনাবাহিনীর বাঁধার মুখে তুর্কী অশ্বারোহীরা হঠাতই পিছু হটতে থাকেন। এতে রাজপুত সেনারা প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে তুর্কী অশ্বারোহীদের ধাওয়া করতে গেলে হঠাতই তুর্কীরা ঘুরে রাজপুতদের উপর বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। রাজপুত সেনাবাহিনী এই কৌশলের সাথে পরিচিত ছিলো না। তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রায় ৩ ঘন্টার মতো রাজপুত বাহিনীর উপর তীর নিক্ষেপ হতে থাকে। অসহায়ের মত দেখা ছাড়া তাঁদের আর করার মতো তেমন কিছু ছিলো না। একপর্যায়ে রাজপুত সেনারা তাঁদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া তাঁদের শারিরীক সামর্থ্যও সহ্যের শেষ সীমায় চলে যায়।
তবে শুধু তুর্কী কৌশলই শেষ না, মুহাম্মদ ঘুরির আরো চমক দেখানো বাকী ছিলো। তিনি এবার তাঁর ১২ হাজার রিজার্ভ সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করেন। একে তো তীব্র আতঙ্কে রাজপুত সেনারা যুদ্ধ করার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেছে, তার উপর পরিশ্রান্ত রাজপুত সেনাদের উপরে আক্রমণ চালায় সম্পূর্ণ সতেজ রিজার্ভ সৈন্যরা। রাজপুত সেনাবাহিনী এবার আর যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারলো না। রাজপুত বাহিনীর শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়। ইতোমধ্যেই পৃথ্বীরাজ চৌহানের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি খান্ডে রাও নিহত হন, যা রাজপুত বাহিনীর চূড়ান্ত পতন তরান্বিত করে।
রাজপুত সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের চেয়ে মৃত্যু অধিক পছন্দ করত। তাই পলায়ন না করে অসহায়ভাবে নিজেদের মাথা তলোয়ারের সামনে পেতে দেয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিলনা। যুদ্ধে অধিকাংশ রাজপুত সেনা নিহত হয়।
যুদ্ধেরই এই পর্যায়ে রাজপুত বীর রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান বন্দি হন এবং পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

ফলাফলঃ

তরাইনের এই দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের সাথে সাথে হিন্দুস্তান থেকে শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজ্যটিরও পতন ঘটে। আর ঠিক এই কারণেই, হিন্দুস্তানের ইতিহাসে হিন্দুদের কাছে বীর পৃথ্বীরাজ চৌহানের গুরুত্ব অনেক বেশি।
এই যুদ্ধের পরেই প্রথম ভারতবর্ষে ইসলামি শাসনের সূচনা হয়।

মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যুঃ-


শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে।
ভারতীয় লোক গাঁথা অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পৃথ্বীরাজ মৃত্যুবরণ করেননি। বরং তিনি বন্দী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বন্দীদশায় সুযোগ পেয়ে মুহাম্মদ ঘুরিকে তিনি হত্যা করেন। মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যুসংক্রান্ত এই মতবাদটি একটু বেশিই কল্পনাপ্রবণ ও অবাস্তব কারণ ঘুরির মৃত্যুর ১৪ বছর আগেই পৃথ্বীরাজ নিহত হন।
ফারিস্তার পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকদের মত হচ্ছে, ১২০৬ সালের ১৫ মার্চ মাগরিবের নামাজ আদায়রত অবস্থায় খোকার বা ইসমাইলিরা
হিন্দুস্তানে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এবং এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত।

তথ্যসূত্র:

১। বিশ্বসভ্যতা (মধ্যযুগ)- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ
২। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
৩। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা
৪। ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি