গবেষণার সংজ্ঞা দাও । গবেষণার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর ।

অথবা, গবেষণা কী? গবেষণার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গবেষণা কাকে বলে? গবেষণার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গবেষণা এক নিয়মিত কার্যক্রম, যা বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন ও ফলাফল প্রদানে সক্ষম বলে বিবেচিত হয়ে থাকে । গবেষণায় প্রত্যয়, পর্যায়, প্রক্রিয়া ও প্রণালি সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আজকের যুগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়ানোর মৌল কারণ হলো যে, গবেষণা আর নিছক আপতিত ব্যাপার নয়, বরং অনুশীলনের ব্যাপার। আর গবেষণা বলতে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেই বুঝায় ।
গবেষণা : গবেষণা মানেই নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান। গবেষণা হচ্ছে প্রণালিবদ্ধ তথ্য অনুসন্ধান। ‘গবেষণা’ শব্দটি বাংলায় এসেছে ইংরেজি ‘Research’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে; যার আক্ষরিক অর্থ ‘পুনঃঅনুসন্ধান’ । ইংরেজি ‘Research’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ফরাসি ‘Herchercher’ শব্দ থেকে, যার মূলগত অর্থ পুনঃঅনুসন্ধান । উপযুক্ত সমার্থক শব্দের অভাবে ‘Research’ কথাটির ব্যাপক তাৎপর্য বাংলা প্রতিশব্দে ধরা পড়েনি । তবে অনুসন্ধান বা এষণা যাই বলি, গবেষণার উদ্দেশ্য সত্যকে আবিষ্কার করা। এই অনুসন্ধান হলো সত্যের অনুসন্ধান ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : নিম্নে গবেষণার সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো : এ প্রসঙ্গে গ্রিনের (Green) উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, “Research is definable as the use of standardize
procedure, in the search for knowledge.” অর্থাৎ, জ্ঞান অনুসন্ধানের জন্য মানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগকেই গবেষণা
হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় । প্রায় অনুরূপ বক্তব্য মেরি ই. ম্যাকডোনাল্ড (M. E. Macdonald) দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “Research may be defined as systematic investigation intended to add to available knowledge in a form that is communicable and verifiable.” অর্থাৎ, গবেষণা এমন একটি সুবিন্যস্ত অনুসন্ধান, যার উদ্দেশ্য বোধগম্য ও যাচাইসাপেক্ষ জ্ঞান দ্বারা প্রচলিত জ্ঞানের উন্নতি সাধন । রেডম্যান এবং মোরি (Redman and Morey) গবেষণার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “Research is the ystematized effort to gain new knowledge.” অর্থাৎ, গবেষণা হলো নতুন জ্ঞান আহরণের জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা ।
রবার্ট রস (Robert Ross) এর মতে, “Research is essentially an investigation a recording and as analysis of evidence for the purpose of gaining knowledge.” অর্থাৎ, গবেষণা হলো মূলত জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে অনুসন্ধান, একটি সমস্যাকেন্দ্রিক অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধান জ্ঞান অর্জন ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য । গবেষণার মাধ্যমে মানুষ তার নিজের সম্পর্কে, তার কাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে, সমাজ, দেশ ও পৃথিবী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয় । এনসাইক্লোপেডিয়া অব সোশ্যাল সায়েন্স (Encyclopedia of Social Science) অনুসারে, “গবেষণা হলো জ্ঞান বর্ধন, সংশোধন বা যাচাইপূর্বক সাধারণীকরণের উদ্দেশ্যে বস্তু, প্রত্যয় বা প্রতীক নিয়ে কাজ করা; যাতে সেই জ্ঞান কোনো তত্ত্ব সৃষ্টি অথবা কোনো কৌশল অনুশীলনে সহায়তা করতে পারে।” গবেষণার মূলকথা হলো সমস্যা; সমস্যা আছে, তার সমাধানের তাগিদে বিশেষ পদ্ধতিতে চিন্তার নামই হচ্ছে গবেষণা।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গবেষণা হলো সত্য অনুসন্ধানের একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া । মানব মনে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বাস্তবতা অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণা তাগিদ সৃষ্টি হয় । মানব মনের জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা এবং একটি বস্তুনিষ্ঠ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টাই হচ্ছে গবেষণা ।
গবেষণার বৈশিষ্ট্য : নিম্নে গবেষণার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
১. গবেষণা হলো একটি মৌলিক কাজ । গবেষণা গবেষকের মৌলিকতার স্বাক্ষর বহন করে ।
২. প্রতিটি গবেষণাকর্মের সুনির্দিষ্ট কতকগুলো উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে প্রতিটি গবেষণা কার্য পরিচালিত হয় । বস্তুত উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ব্যতীত কোনো গবেষণাকর্মই সম্পন্ন করা যায় না ।
৩. সাধারণত সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই গবেষণা কার্য পরিচাল িত হয় ।
৪. কোনো বিশেষ দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে গবেষণা করতে হয় ।
৫. গবেষণার মান নির্ভর করে গবেষকের কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গির উপর ।
৬. গবেষণার মূল বিষয় সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে হয়। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের শৃঙ্খলাবোধ গবেষণার প্রথম শর্ত। গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুপুঙ্খ ও ব্যাপক তথ্যগত যথার্থতা এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ শৃঙ্খলাবোধ ব্যতীত পরিণত গবেষণা সম্ভব নয় ।
৭. কোনো বিষয়ে নতুন কোনো নিয়ম-নীতি বা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এবং সেই সিদ্ধান্তের সাধারণীকরণই হলো গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।
৮. গবেষণা যেহেতু একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, তাই এর মূলভিত্তি যুক্তি, পরিমাণ বা পরিসংখ্যানগত উপস্থাপনার উপর প্রভূত নির্ভরশীল ।
৯. গবেষণা হলো তার কারণ ও ফলাফল। অর্থাৎ অনুসন্ধান ও সিদ্ধান্তের এক সম্মিলিত গঠন পদ্ধতি ।
১০. গবেষণা হলো প্রণালিবদ্ধ তথ্য অনুসন্ধান । অর্থাৎ গবেষণা হচ্ছে অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ এবং ধারণা ও তত্ত্ব গঠন করার একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি ।
১১. গবেষণা হলো গবেষকের জ্ঞান ও বুদ্ধির সচেতন প্রয়োগ ও প্রকাশ ।
১২. গবেষণা প্রচলিত জ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সংযোজন ঘটায় ।
১৩. গবেষণা নতুন প্রমাণাদির সাহায্যে পুরাতন ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে এবং
১৪. গবেষণা পুনঃঅনুসন্ধান ও পুনঃযাচাইযোগ্য ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গবেষণা হলো নতুন কিছু জানা তথা নতুন সত্য ও জ্ঞান আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান । এটি হলো কোনো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিচালিত কাঠামোবদ্ধ অনুসন্ধান । এর মূল। উদ্দেশ্য হলো সর্বাধিক মানব কল্যাণ সাধন করা।