কাজী নজরুল ইসলামের ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতায় বিরহক্লিষ্ট প্রেমিক কবির পরিচয় ফুটে উঠেছে।”- উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।

অথবা, চৈতী হাওয়া’ কবিতা অবলম্বনে নজরুল ইসলামের কবি মানসের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
উত্তরায় ভূমিকা :
কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার এক অবিনাশী গান ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতা। রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রবলয় ভেদ করে বিদ্রোহের সুর নিয়ে এলেন নজরুল। কবি নজরুল মাটি ও মানুষের কবি- এদেশের হৃদয়ের কবি। চৈত্রের রৌদ্রদগ্ধ প্রকৃতির মতোই কবির বিরহী সত্তার মর্মমূলে বাজতে থাকা ব্যথা ও বেদনা এ কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাই চৈতী হাওয়া’ কবিতাটি প্রেম ও বিরহের কবিতা। কবিতার শুরুতেই সে সুর ধ্বনিত হয়-


হারিয়ে গেছ অন্ধকারে পাইনি খুঁজে আর
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবর।’


প্রিয়া হারানো ব্যথা : এক চৈতালি দিনে কবির জীবনে এসেছিল প্রেম। এ প্রেম কবি ও প্রিয়ার মধ্যে ভালোবাসার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। এক চৈতালি দিনে কবির প্রিয় কবিকে ভালোবেসে উন্মাতাল করেছিল। কিন্তু আজ তাঁর প্রিয়া হারিয়ে গেছে। সময়ের স্রোতে কবির ভালোবাসার সুখ বিলীন হয়েছে। কবি বার বার প্রিয়তমাকে খুঁজেছেন। প্রকৃতির মাঝে প্রিয়ার প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। কবির এক সময় জীবন ছিল শূন্য, প্রিয়া হারানো যাতনা ছিল না। কবির প্রিয়তমা গরল বিষ ঢেলে কালের চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। তাই হাজারো ভিড়ের মাঝে কবি তাঁর প্রিয়াকে খুঁজেছেন-


‘আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল পা’


কবির জীবনে ব্যর্থ প্রেম : কবির জীবন ছিল শান্ত ও শীতল। তাঁর জীবনে প্রিয়া হারানোর কোন ভয় ও যাতনা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ এক চৈতালি দুপুরে কবির জীবনে প্রেমের আগমন ঘটল। ফুলে ফলে শোভিত হলো জীবন। সে জীবন ছিল শান্ত দীঘির মতো, সে জীবনে কোন ব্যথার নীলোৎপল ফুটানোর প্রয়োজন ছিল না। এক শুভ বসন্ত লগ্নে প্রিয়াকে পেয়েছিলেন তিনি। অথচ তাঁর জীবনে অসংখ্য বসন্ত এল কিন্তু প্রিয়াকে পেলেন না। তাই কবি অদৃশ্য অস্তিত্বকে সামনে রেখে প্রিয়াকে স্মরণ করেছেন-


শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল৷

৷ কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?)


কবিপ্রিয়ার সন্ধানে ব্যাকুল : প্রিয়া হারানো ব্যথায় কবি নিঃস্ব ও রিক্ত। হারানো প্রিয়া কবিকে ভুলে গেলেও কবি প্রিয়াকে ভুলতে পারেননি। সে প্রিয়া কবির জীবনে কর্মচাঞ্চল্য এনে দিয়েছিল। আজ কবির জীবন কর্মহীন। কবির কর্মকোলাহলময় জীবন ভালো লাগে না। অসংখ্য ভিড়ের মাঝে কবি তাঁর প্রিয়াকে খুঁজছেন। কবি তাঁর প্রিয়ার কমল পা খুঁজে পেতে চান। অনন্তকাল ধরে কবি তাঁর প্রেমসারথীকে খুঁজে যাবেন। হাজারো ভিড়ের মাঝে আজও খুঁজে চলেছেন-


‘বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুমরে উঠে মন
পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।’


প্রকৃতির বিরহ দ্যোতনা : চৈতী হাওয়া কবির জীবনে প্রেমের পরশ এনেছিল। মহুয়া বনে নেশা ধরা মহুয়া ফলের রস কবিকে মাতাল করেছিল। দখিনা হাওয়ায় নৈসর্গিক প্রকৃতির মাঝে কবি তাঁর প্রিয়ার মাঝে মত্ত হয়েছিলেন। আজ সেই চৈতালি ফিরে এসেছে। কিন্তু কবিপ্রিয়া আজ বিরহ ব্যথার রাগিণী। যাকে পাবার জন্য কবিপ্রিয়া ব্যাকুল। তার দরশন মিলছে না। ফিরে আসা চৈতী হাওয়ার স্মৃতি আবার জাগ্রত হয়েছে। তাই কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-


‘কণ্ঠে কাঁদে একটি স্বর
কোথায় তুমি বাঁধ ঘর।’


কবির প্রত্যাশা : বিরহ মানুষকে বেদনা দেয়। কবির প্রিয়া দূরে চলে গেছে। কিন্তু রেখে গেছে কিছু কষ্টময় স্মৃতি। এ স্মৃতি কবি কখনো ভুলতে পারেন না। তবুও কবি প্রত্যাশা করেন তাঁর প্রিয়া যেখানেই থাকুক, যার সাথে ঘর বাঁধুক, অন্তঃস্থলে শুধু কবির অধিষ্ঠান। কবির প্রত্যাশা যে হৃদয়ে কবি একবার জায়গা করে নিয়েছেন সে হৃদয়ে অন্য কেউ জায়গা করে নিতে পারে না। কবির প্রিয়া হয়ত আগমনী বার্তা নিয়ে কবিহৃদয়ে ফিরে আসবে। তাই কবি প্রিয় মানুষটির প্রত্যাশায় বলেছেন-


‘তেমনি করে জাগছ কি রাত আমার আশাতেই?৷

কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই?’


প্রিয়ার জন্য অন্তহীন অপেক্ষা : কবি অনাদিকাল ধরে প্রিয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন। যদি কখনো প্রিয়ার সাথে দেখা হয়, তাহলে এক তরীতে পাড়ি দিবেন যেখানে নেই কোন বিরহ ও হারানোর ভয়। কবির প্রেম এ আশাবাদের ভিতর স্বর্গীয় সুখ সম্ভোগ করেছে। কবির প্রত্যাশা প্রিয়ার সাথে পুনর্মিলন হবে। কবি ও কবির প্রিয়া অনাদিকাল যুগলবন্দী হয়ে থাকবেন-


‘আবার তোমার সুখ ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে নায়
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ,
জী পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না।’


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, চৈতী হাওয়া’ কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম সার্থক প্রেমের কবিতা। এ কবিতায় কবি প্রেমের বিরহকেই ভাষাশৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটি নজরুল প্রেমভাবনা ও রোমান্টিক ভাবনার এক অবিস্মরণীয় দলিল। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার আড়ালে যে অন্তহীন প্রেমভাবনা প্রবহমান তা-ই এ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।