ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কারণ আলোচনা কর।

অথবা, কী কী কারণে ওজোন স্তরের ক্ষয় সাধিত হয়ে থাকে? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কারণসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, ওজোন স্তরের ক্ষয় হয় কোন কোন কারণে? সবিস্তারে উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানবসভ্যতার দ্রুত অগ্রগতির পাশাপাশি কিছু পরিবেশগত ঝুঁকিও মারাত্মক আকার ধারণ করছে, যারা মানবসভ্যতাকে হুমকির মুখেঠেলে দিচ্ছে। এ পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে ওজোন স্তরের ক্ষয় অন্যতম । দ্রুত শিল্পায়ন ও শহরায়ন প্রক্রিয়া ওজোন স্তরের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছে। তবে বিশ্বব্যাপী মানুষ বর্তমানে এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেছে। তাই তারা ওজোন স্তরের ক্ষয়রোধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। তবে এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ওজোন স্তরের ক্ষয় : ১৯৫৭ সাল থেকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা কুমেরু অঞ্চলের আকাশে ওজোনের পরিমাণ নিয়োজিত রেকর্ড করার চেষ্টা করে আসছেন। উল্লেখযোগ্য ওজোন শূন্যতার বিষয়টি বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ১৯৮৩ সালে। ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিকা সার্ভে’ নামে এ ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থায় তাদের পর্যবেক্ষণ শেষে জানায় যে, অ্যান্টার্কটিকার বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ওজোন গ্যাস এক আশ্চর্য রকম হারে কমে যাচ্ছে। প্রতিটি বসন্তে কুমেরুর আকাশে ওজোনের পরিমাণ কমে যায় এবং নভেম্বর মাসের দিকে ওজোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বেশ স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। প্রথমটায় মনে করা হয়েছিল, সূর্য কলংকের কারণে কিংবা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অদ্ভূত রকমের আবহাওয়া প্রক্রিয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। কোন কোন বিজ্ঞানীর মতে, বাতাস এর জন্য দায়ী। কিন্তু পরে দেখা গেছে কিছু কিছু অপ্রমাণিত এবং অজ্ঞাত কারণ থাকলেও মানুষ সৃষ্ট কিছু কারণই ওজোন স্তরদ্বয়ের জন্য প্রধানত দায়ী ।
ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ : ওজোন স্তর ক্ষয়ের পিছনে যে রাসায়নিক প্রক্রিয়া কাজ করছে তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসডিয়নায় অবস্থিত। ‘অ্যান্টার্কটিকা জাতীয় ওজোন অভিযানের সদস্য ‘জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরী’ এর পদার্থবিজ্ঞানীরা জানিয়েছে যে, ওজোন স্তরের ধ্বংসের কাছে সি. এফ. সি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন) সরাসরি জড়িত।
সিএফসি ক্লোরিন, ফ্লোরিন ও কার্বনের একটি যৌগ। সব সিএফসি-ই ওজোন স্তরের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে, বিশেষত সিএফসি-১১ ও সিএফসি-১২ সিএফসি অণু ভেঙে যে ক্লোরিন গ্যাস নির্গত হয়, তা ওজোনকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে। ১৯২০ সালে আবিষ্কৃত এ যৌগটি বিষহীন ও নিষ্ক্রিয়। সহজে অন্য কোন পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে না। ফ্রিজ, এয়ারকুলার, স্প্রে, ফ্যান, প্লাস্টিক ফোম, মাইক্রোইলেকট্রিক সার্কিট পরিষ্কার করা, বুদবুদ তৈরিতে প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ গ্যাস বর্তমানে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। সিএফসি বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারের অক্ষত অবস্থায় রয়ে যায় এবং ভালোভাবে মিশে থাকে। সিএফসি-১১ ও সিএফসি-১২ ট্রপোস্ফিয়ারে মেশার অনুপাত যথাক্রমে ১৯০ ও ৩৫০ পিপিবি এর ঘনত্ব বছরে ৫-৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু স্ট্রটোস্ফিয়ারে গিয়ে তা সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেঙে যায় এবং মুক্ত ক্লোরিন পরমাণু ও জোনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরিন ও মনোক্সাইড ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। ক্লোরিন মনোক্সাইড আবার মুক্ত অক্সিজেন পরমাণুর সিএফসি সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিজেন গ্যাস ও মুক্ত ক্লোরিন পরমাণু উৎপন্ন করে এবং এ প্রক্রিয়া অনবরত চলতে থাকে। নির্গত প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণু ওজোনের ১ লাখ অণু ভেঙে দিতে পারে। একটি সিএফসি অণুর ৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌছাতে ১৫ বছর পর্যন্ত লাগতে পারে এবং বৃষ্টির সাথে হাইড্রোক্লোরিক এসিড হিসেবে ফিরে আসতে সময় লাগতে পারে ৫০ থেকে ১ ০০ বছর। স্ট্রাপোস্ফিয়ারে যেহেতু প্রবল সমান্তরাল বাতাস বয়ে থাকে, সে কারণে খুব অল্প সময়ের ভিতরেই সিএফসি এর মতো দূষক ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে। CFCI ছাড়া মিথাইল ব্রোমাইড এবং সালফারের কণিকাসমূহ ওজোন স্তরের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। নিম্নে একটি ছকের ওজোন ক্ষয়কারী গ্যাসসমূহের তালিকা দেওয়া হলো :
O3 ক্ষয়কারী বস্তু > ব্যবহারের কেন্দ্ৰ
CFC-11 > রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশনিং
CFC – 12 > এরোসন, ফোম প্রস্তুতকরণ
CFC-113 > এরোসল ফোম প্রস্তুতকরণ
HFC-22 > এরোসল ফোম প্রস্তুকরণ
হ্যালন-121 > অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র
হ্যালন-130 > অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র
মিথাইল ক্লোরোফম > দ্রাবক, পরিষ্কারক ইত্যাদি।
মিথাইল ব্রোমাইড > খাদ্য গুদাম।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বায়ুমণ্ডলের চতুর্থ স্তরকে ওজোন স্তর বলে। এ স্তর ভূপৃষ্ঠের ৬৫ মাইল উপরে অবস্থিত। এ স্তরের কাজ হচ্ছে সূর্য হতে আগত সকল অতিবেগুণী (Ultraviolet) রশ্মি শোষণ করা এবং পৃথিবী থেকে উত্থিত সকল শব্দকে প্রতিফলিত করা।