আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মত অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে। আবার এমনি অভিযোগ আনয়নকারী বহু রাজাও মরেছে। কিন্তু কোনকালে কোন কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি, তার বাণী মরেনি।”- ব্যাখ্যা কর।

উৎস : আলোচ্য অংশটুকু আত্মপ্রত্যয়ী প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গ : মানুষ মরণশীল হলেও সত্য যে শাশ্বত ও অমর এ চিরন্তন কথাটিই এখানে গুরুত্ব পেয়েছে।
বিশ্লেষণ : প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ থেকে ধনী-নির্ধন, রাজা-প্রজা, ছোটবড় কেউ রেহাই পাবে না। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই অর্থসম্পদ, ক্ষমতা আর প্রভাব প্রতিপত্তির বাহাদুরি প্রকাশ করে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে একদল লাভবান হয় অন্যদল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ লাভ-ক্ষতি তো একেবারেই সাময়িক। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এবং অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়। তখন শৌষক আর অত্যাচারীদের সম্বল হয় আফশোস আর অনুশোচনা। অহঙ্কার, দন্ত, আকাশচুম্বী ক্ষমতা ধুলোয় মিশে যায়। আজকে যারা অভিযোগকারী তারা তখন অভিযুক্ত হিসেবে প্রমাণিত হয়। কারণ মিথ্যা, অন্যায়, প্রতারণা আর ক্ষমতার আস্ফালন সত্য এবং ন্যায়ের কাছে পরাজিত হয়। জয় হয় সুন্দরের। সহজ-সরল, অসচেতন, অধিকারহীন পরাধীন মানুষকে মানসিক দিক থেকে সচেতন ও জাগ্রত করার অপরাধে ক্ষমতায় অন্ধ রাজশক্তি কবিকে কারারুদ্ধ করেছিল। কিন্তু কবি জানেন তিনিই সত্য। মানুষকে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে জানানো অন্যায় নয়। তাদেরকে নিজ অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ে উদ্বুদ্ধ করা রাজদ্রোহ নয়। কিন্তু রাজশক্তি এত অহঙ্কারী যে, তারা সত্যকে স্বীকার করে না। সত্যকে পাশ কাটিয়ে চলে। কিন্তু কবি জানেন, অনেক রাজবিদ্রোহীর মতো কবিরও মৃত্যু হবে। আবার অনেক ভিযোগকারীর মতো – রাজারও মৃত্যু হবে। কিন্তু সত্য চির অমর, ন্যায় এবং সুন্দরের মৃত্যু নেই। মৃত্যু সকলের জন্য অনিবার্য-এটা যেমন সত্য, তেমনি এষ্টা প্রদত্ত সত্য, ন্যায়, সুন্দর ও সত্য। সত্য চিরকালীন।
মন্তব্য : মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ক্ষমতাসীনরা মৃত্যুভয়ের চাইতে অর্থ সম্পদ, ক্ষমতা মোহকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ন্যায়, সত্য ও সুন্দর সব কিছুর ঊর্ধ্বে চিরস্থায়ী ও চিরঅমর।