অস্তিত্ববাদ ও নারীবাদের সম্পর্ক আলোচনা কর ।

অথবা, অস্তিত্ববাদ ও নারীবাদের তুলনামূলক বর্ণনা কর।
অথবা, অস্তিত্ববাদ ও নারীবাদের সম্পর্ক সম্পর্কে যা জান বিস্তারিত লিখ।
অথবা, অস্তিত্ববাদ ও নারীবাদ সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
অথবা, নারীবাদ ও অস্তিত্ববাদের মধ্যে তুলনামূলক ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নারীবাদ ও অস্তিত্ববাদ এর মধ্যকার সম্পর্ক বিস্তারিত তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
অস্তিত্ববাদী নারীবাদের প্রবক্তা বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী সিমন ডি বিভর। তাঁর ‘Second Sex’ গ্রন্থটি জগৎ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নারীর অস্তিত্ববাদে তিনি বিভিন্ন তাত্ত্বিকের আশ্রয় নেন। তিনি নারীবাদে তাঁর স্বামী জেন পল সার্টের অস্তিত্ববাদ তত্ত্ব প্রয়োগ করেন। যদিও তিনি কিছুটা ভাববাদী, তবে তাঁর মতবাদে প্রতিভা ও মুক্তবুদ্ধিবৃত্তির যে প্রকাশ পায় তা অস্বীকার করা যায় না। নারীকে স্ত্রী, মা ও শ্রমজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সমাজ জেন্ডার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। ফলে এটি পুরুষ শাসিত সমাজের সৃষ্টি, নারীর নয়। নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব সৃষ্টি করার জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দুর্বল ও বিবেকশূন্য হিসেবে দেখেছেন। নারীরা প্রতিকূল পরিবেশের বিপরীতে না গিয়ে পুরুষদের চাপিয়ে দেয়া নীতিকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে। সত্য বলতে কি, মানতে বাধ্য হয়েছে অবলা, বঞ্চিত, দুর্বল নারীসমাজ।
অস্তিত্ববাদ ও নারীবাদ : নিজ ও অপরের মধ্যে সংঘাত লাগলেই অস্তিত্ববাদের আবির্ভাব ঘটবে। কেননা, সংঘাত ও দ্বন্দ্বের মাধ্যমে একটি পক্ষ পরাজিত হবেই। পরাজিত পক্ষ এক সময় অস্তিত্বের সম্মুখীন হয়। নারী ও পুরুষের সাথে সংঘাত সমাজে এমনিভাবে লেগেই থাকে। তাই পুরুষ নারীর উপর একাধিপত্য ও অস্তিত্ববাদের জন্ম দিয়েছে।
নারীবাদ ও অস্তিত্ববাদের সম্পর্ক নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. নারী ও পুরুষের মধ্যে সংঘাত : সিমন অস্তিত্ববাদের ব্যাখ্যায় বলেছেন, নারী পুরুষের সংঘাত অনিবার্য। নারী ও পুরুষের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সংঘাত লেগেই থাকে। পুরুষ নিজেকে ‘নিজ’ এবং নারীকে ‘অপর’ নামে অভিহিত করে। ফলে সমাজে বৈষম্যের উদ্ভব হয়। যেহেতু ‘অপর’ নিজের প্রতি হুমকিস্বরূপ। কাজেই পুরুষ নিজের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে নারীকে পদানত করে রাখে। বস্তুত পুরুষ নিজের স্বাধীনতা নির্বিঘ্ন করার জন্য নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নারীকে পুরুষের অধীনতাপাশে আবদ্ধ রাখে, যা নারীর অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
২. মানুষ ও প্রাণীর নব জীবন লাভ : মানুষের সাথে প্রাণীকূলের পার্থক্য হলো মানুষ ও প্রাণী উভয়ই নতুন জীবন সৃষ্টি করে। কিন্তু মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারে এবং সৃষ্টিশীল মানসিকতার পরিচয় দেয়। প্রাণীরা জীবনের ঝুঁকি নেয় না। অপরপক্ষে, নারী শুধু নতুন জীবন দান করে। কিন্তু পুরুষ প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হত্যা করতে অথবা
নিহত হতে পরোয়া করে না। নারীরা এখানেই পুরুষের চেয়ে দুর্বল হিসেবে গণ্য হয়। কাজেই পুরুষ নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে এবং প্রভাব খাটায়।
৩. নারী ও পুরুষের ভিন্নতা : নারী বিভিন্ন দিক দিয়ে পুরুষ থেকে ভিন্ন। প্রজননে নারীর ভূমিকা পুরুষের থেকে ভিন্ন, তাছাড়া দৈহিক শক্তিতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। যৌন মিলনে নারী নিষ্ক্রিয় এবং পুরুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। পুরুষের ইচ্ছাকে যৌন মিলনে প্রাধান্য দেয়া হয় আর নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়। কাজেই মানুষের মনমানস নারীকে নিজ থেকে আলাদাভাবে তাকে বিরুদ্ধ শক্তি গণ্য করে। তাদেরকে অপর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাজেই পুরুষ নিজের স্বাধীন সত্তা নিশ্চিত করার জন্য নারীকে ব্যবহার করে। সমাজের পুরুষগুলো নারীকে নিজ থেকে পৃথক মনে করে এবং এদের উপর প্রভুত্ব ব িস্তার করে। ফলে নারীর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
৪. রূপকথার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ : নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষ নানা মিথ (Myth) বা রূপকথার জাল বুনেছে। নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে বিচারশক্তি শূন্য, অবিবেকী, রহস্যময়ী, জটিল ও অস্বচ্ছরূপে : নানাভাবে নারীকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যে, আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জনই হলো নারীর আদর্শ। নারী কেবল দাস হিসেবে জন্ম নিয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, আদর্শ নারীর যে রূপ পুরুষ চিত্রায়িত করেছে, নারী সে রূপকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিজেকে সেরূপে রূপায়িত করেছে, কোনো প্রতিবাদ করেনি। সমাজের প্রভাবকে তারা মেনে নিয়েছে বিনা প্রতিবাদে।
৫. সামাজিক ভূমিকা : সিমন (Simone) বলেছেন যে, “নারীর সামাজিক ভূমিকা নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুরুষের অন্যতম প্রধান অস্ত্র।” পুরুষ ‘অপর’ হিসেবে নারীকে ‘নারীত্ব’ স্বীকার ও সুরক্ষা করতে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। সিমন আরো বলেছেন, নারীর স্ত্রী ও মাতা ভূমিকা তার স্বাধীনতা অর্জনের অন্তরায়। কেননা, স্ত্রী ও নারী হিসেবে তাদেরকে শোষণ করা হয়। বিবাহ বস্তুত দাসত্ব, পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর কর্তব্য সুচারুরূপে সম্পাদনের ব্যবস্থা। সন্তান ধারণ ও সন্তান পালন নারীকে এমন ব্যাপৃত করে রাখে যে, জীবনের অন্যান্য দিকগুলোর দিকে তাকানোর কোনো অবকাশ নারীর থাকে না। ফলে নারীর অবদান থেকে বঞ্চিত হয় সমগ্র জাতি।
৬. পুরুষের সৃষ্ট বৈষম্য : নারীদের বৈষম্যের জন্য পুরুষ বিভিন্ন রকম ফাঁদ পেতেছে। সিমনের মতে, “ট্রাজেডি এই যে স্ত্রী, মাতা ও কর্মজীবী রমণীর তথাকথিত ভূমিকা তাদের নিজেদের সৃষ্ট ভূমিকা নয়। পুরুষ তার নির্মিত কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান এ ভূমিকাগুলোর নির্মাতা।” ফলে পুরুষের অনুকূলে যায় এ কাঠামোর বিষয়গুলো। তবে নারীও মানুষ; পুরুষের মনমানসিকতা যেন ‘নিজ’ অস্তিত্বকে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য নারীর অস্তিত্বকে পদানত করে রেখেছে। মানুষ হিসেবে নারীও তার মনমানসকে নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে স্বাধীনচেতা হতে পারে। কিন্তু এ পথে প্রতিবন্ধক হলো পিতৃতন্ত্র । এভাবেই নারীরা পুরুষের ফাঁদে পড়ে বঞ্চিত হচ্ছে।
নারী বুদ্ধিজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে নারীকে অপর অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীকে বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করতে হবে। তাকে চিন্তা, গবেষণা ও মত প্রকাশ করতে হবে। নারীকে নিয়ে পুরুষ এতকাল চিন্তা ও গবেষণা করেছে বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে। এখন নারীকে এগিয়ে আসতে হবে, নিজের সম্পর্কে নিজস্ব বক্তব দিতে হবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, নারীকে ‘অপর’ অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে এসে নিজ অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে। নারীর অর্থকরী কর্মগ্রহণ তার সম্ভাবনা বাস্তবায়নের সুযোগ এবং প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে। নারীকে প্রতিবাদী হতে হবে। কেননা, কখনো কোনোকিছু বিনা শ্রমে লাভ করা যায় না। তাই নারীদের সচেতনভাবে সামাজিক সকল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে অধিকার আদায় করতে হবে। আলোচিত শর্তগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে নিজেদেরকে পরিত্রাণ পেতে হলে নারীদেরকে সক্রিয় ভূমিকা পালন ছাড়া কোনই গত্যন্তর নেই।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%80-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%a4%e0%a6%bf-%e0%a6%90%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%93/