সুফি তরিকা কাকে বলে? প্রধান প্রধান সুফি তরিকাসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সুফিবাদ একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। আর এ সুফিবাদের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ পীর বলে অভিহিত করা হয় হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কে। সেজন্য হযরত রাসূলে কারীম (স.) থেকেই সমস্ত তরিকার উদ্ভব। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে বিভিন্ন তরিকার নিয়মাকানুন এবং আধ্যাত্মিক সুলুক ও তালিম সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ হয়। পৃথিবীতে প্রায় তিন শতাধিক তরিকা রয়েছে এবং অসংখ্য তরিকা অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তলিকাসমূহের
মধ্যে চারখানা প্রসিদ্ধ তরিকা রয়েছে যা নিচে আলোচ্য।
→ সুফি তরিকা : সুফি তরিকা অর্থ পথ বা রাস্তা। সুফি তরিকা বলতে বুঝায় যাকে কেন্দ্র করে একজন সাধক মহৎ উদ্দেশ্যে আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ করে এবং আল্লাময় হয়ে যায়।
→ প্রধান প্রধান সুফি তরিকা : অসংখ্য সুফি তরিকা রয়েছে। আবার অনেক সুফি তরিকার শাখা প্রশাখা রয়েছে। এদের মধ্যে চারটি
তরিকা প্রধান। ইসলামে ৪ জন পীরের নামে এই তরিকার নামকরণ করা হয়েছে। নিচে প্রধান ৪টি তরিকার নাম দেওয়া হলো-
১. হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.) চিশতীয়া তরিকা।
২. হযরত শায়েখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) কাদিরীয়া তরিকা।
৩. হযরত শায়েখ খাজা ‘বাহাউদ্দীন নকশাবন্দ (র.) নকশাবন্দিা তরিকা ।
৪. হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানী (র.) মুজাদ্দাদিয়া তরিকা। নিচে প্রধান তরিকাগুলোর আলোচনা করা হলো :
১. চিশতীয়া তরিকা : হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী হাসান সানযারী আল আজমিরী (রহ.) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কুতুব। হযরত খাজা সাহেব ৫৩ হিজরি সালে
ইরানের সানযার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। এরপর তিনি পিতৃ সূত্রে একটি
বাগান পেয়েছিল। একদিন তিনি বাগানের মধ্যে আরাম করছিলেন এমন সময় বিখ্যাত মঞ্জুব ফকীর ইবরাহীম কানদুযী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি তার ঝুড়ি থেকে কিছু শুষ্ক খেজুর বের করে খাজা সাহেবের মুখে পুরিয়ে দেন। পরে খাজা সাহেবের পেটে দারুণ বিপ্লব শুরু হয়। পরে তিনি আল্লাহর ওয়াস্তে সবকিছু বিলি করে সম্পূর্ণ নিঃসম্বল অবস্থায় রাস্তার
বেরিয়ে পড়েন। তিনি সমরখন্দ ও বোখারায় গিয়ে কুরআন, হাদিস, তফসীর, ফিকাহ্ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন এবং
পরে তিনি ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত হন। তিনি ৩৩ হিজরি বা ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ই রজব তারিখে ইন্তেকাল করেন।
২. চিশতীয়া তরিকার তালিম : চিশতীয়া তরিকার খাস তালিম হলো খামসা আনাসিরের তালিম। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর
শিক্ষানুযায়ী এই তালিম হযরত আলী (রা.) এর মাধ্যমে হযরত হামাল বসরী (রহ.) থেকে হযরত ওসমান হারুনি পর্যন্ত লাভ করেন। এই তরিকায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিশেষ আয়াত বা দরুদের সাহায্যে আদায় করার গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই তরিকায় বিভিন্ন যিকির ও আল্লাহ্ প্রেমমূলক গযল প্রচারিত আছে। এই তরিকায় একসাথে ৪০ দিন দুনিয়ার সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে নির্জন স্থানে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকার কথা বলা হয়েছে।
৩. কাদেরিয়া তরিকা : এই তরিকার প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কুতুব হলেন হযরত শায়েখ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) বাংলাদেশে তিনি একজন বড় বলে পরিচিত। হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.) পারস্যের জিলা গিলান প্রদেশে ৪৭০ হিজরি
বা ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর বাগদাদে গমন করেন এবং সেখান থেকে কুরআন, তফসীর, ফিক্হ, মানতিক, তাসাউফ প্রভৃতি শিক্ষা লাভ করেন।
তিনি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। তিনি সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত, মহাপুরুষ ও অসাধারণ শক্তিশালী সুফি ছিলেন।
৪. কাদেরিয়া তরিকার তালিম : কালেমা শরীফ “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” এই ১২টি হরপের তালিম কাদেরিয়া তরিকার খাস তালিম। এই ১২টি শব্দই বিশ্ব জগতের মূল কারণ ও উৎস। এই তরিকার একটি বিশেষত্ব হলো মোশাহেদায় মগ্ন থাকা এবং নফী-ইসবা ত যিকির করা। কাদিরীয়া তরিকার প্রধান ও আদি ৯টি শাখা রয়েছে। যথা- হাবিবিয়া, তাইফুরিয়া, কারাথিয়া, সবতিয়া, জুনায়েদিয়া, গড়ার দিদিনিয়া, তুরতুসিয়া, কারতুসিয়া,
সোহরাওয়ারদীয়া। কাদিরীয়া তরিকা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলো ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ,
আরব, মরক্কো, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে বিস্তার লাভ করে ।
৫. নকশাবন্দিয়া তরিকা : নকশাবন্দিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কুতুব ছিলেন হযরত শায়েখ খাজা মুহাম্মদ
বাহাউদ্দীন মুহাম্মদ নকশাবন্দ আল-বোখারী (রহ.)। নকশাবন্দিয়া তরিকা তরিকত অপেক্ষা শরিয়তের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ
করে। খাজা বাহাউদ্দিন নকশাবন্দ ৭০৮ মতান্তরে ৭১৮ হিজরিতে মধ্য এশিয়ার বোখায়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি বিভিন্ন নকশা খচিত কাপড় চয়ন করতেন। তিনি সাধক ও পীর রূপে পরিগণিত হওয়ার পর যে দিকেই তাকাতেন সেদিকেই আল্লাহ্
নামের নকশা অঙ্কিত হত। এসব কারণে তাকে নকশাবন্দ বলা হয় এবং তার প্রতিষ্ঠিত তরিকাকে নকশাবন্দিয়া তরিকা নামে অভিহিত করা হয়। তিনি শহুদিয়া পন্থি সাধক ছিলেন। তিনি ৭৯২ হিজরিতে বা ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
৬. নকশাবন্দিয়া তরিকার তালিম : নকশাবন্দিয়া তরিকার প্রধান তালিম হচ্ছে লাতায়েফে সিত্ত (ছয় লতিফা) ও আরবায়ে আনাসির (আব, আতশ, খাক ও বাত) এর ভিন্ন ভিন্ন মোরাকেবা। নকশাবন্দিরা তরিকার সুফিগণ শরিয়তের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। নকশাবন্দিয়া তরিকায় নিম্নস্বরে জিকির করার বিধান রয়েছে। এ
তরিকার কোনো কোনো শাখা গজল ও সামা শ্রবণ বৈধ মনে করে। নকশাবন্দিয়া তরিকাত ও এর শাখা প্রশাখা বাংলাদেশ, ভারত, চীন,
পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
৭. মুজাদ্দাদিয়া তরিকা: মুজাদ্দাদিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইমাম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কুতুব হলেন হযরত শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহ.)। মুজাদ্দিদ অর্থ সংস্কারক। তিনি সমসাময়িক কালে সুফি তরিকা বা ইসলামের সংস্কার সাধন করেছিলেন বলে তাকে মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানী বলা হয়। তিনি হিজরি ৯৭১ সালে বা ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের ‘সেরহিন্দ’ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিভিন্ন তরিকা সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন এবং নকশাবন্দিয়া তরিকার সংস্কার সাধন করেন। তিনি ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
৮. মুজাদ্দাদিয়া তরিকার তালিম : মুজাদ্দাদিয়া তরিকার মূল তালিম হচ্ছে “লাতায়িফে সিত্তা, আরবা আনাসির ও হাযরাতুল খামস-
এর মেরাকেবা। তিনি আদি চিশতীয়া, কাদিরীয়া ও নকশাবন্দিয়া.তরিকাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ও সংস্কার করেন। এই সংস্কার সাধন করতে গিয়ে তিনি ওয়াহিদাতুশ শহুদিয়া পন্থা অবলম্বন করেন। মুজাদ্দাদিয়া তরিকার কোনো কোনো শাখা যিকরে জলীর উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন এবং বাদ্যবিহীন শুষ্ক হামদ ও নাত শ্রবণ করেন। মুজাদ্দাদিয়া তরিকা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বার্মাসহ অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামের প্রারম্ভে সুফিবাদের যাত্রা শুরু হয়। সুফিরা সহজ সরল পথে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন এবং পানা ও বাকা অতিক্রম করে তারা আল্লাময় হয়ে ওঠেন। বিখ্যাত সুফিরা কিছু তরিকা সৃষ্টি করেছিলেন। সুফি তত্ত্বকে জানতে ও বুঝতে হলে এসব তরিকার মাধ্যমেই তা জানতে হবে। এসব তরিকার মাধ্যমের হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর তালিম রয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%86/