সুফিবাদ বলতে কী বুঝায়? সুফিবাদে ভারতীয় প্রভাব কতটুকু? এ প্রসঙ্গে সুফিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, সুফিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যে পার্থক্য লেখ।
অথবা, সুফিবাদ কাকে বলে? সুফিবাদে কিরূপ ভারতীয় প্রভাব রয়েছে? এ প্রসঙ্গে সুফিবাদ ও মরমিবাদ তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সুফিবাদ ও মরমিবাদের পার্থক্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সুফিবাদ ও মরমিবাদের পার্থক্য বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সুফিবাদ আল্লাহর প্রেম ও ধ্যানের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি মরমি চিন্তাধারা। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ইসলামে যে মরমি ভাবধারার উদ্ভব হয় তাই সুফিবাদ নামে পরিচিত। মুতাজিলাদের বুদ্ধিবাদ এবং আশারিরদের গোঁড়ামি ও অন্ধ-আনুষ্ঠানিকতার প্রতিবাদস্বরূপ ইসলামে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটে। সুফিবাদ অনুসারে খোদা প্রেমময়। খোদার সাথে মানুষের এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। সুতরাং সুফিবাদ ইসলামের বহির্ভূত কোন বিষয় নয়, এটা ইসলামের অন্যতম প্রধান।
সুফিবাদে আর্যীয় বা ভারতীয় প্রভাব : ভারতীয় দর্শনের একটি বিশেষ দিক হলো আধ্যাত্মিকতা। এ দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন যে, সুফিবাদ ভারতীয় প্রভাবে মরমি ভাবধারা গড়ে উঠেছে। H. Merten, Goldzither প্রমুখ চিন্তাবিদগণ এরূপ অভিযোগ করেন। তাদের বক্তব্য হলো সুফিবাদ বেদান্ত দর্শন ও বৌদ্ধদর্শন হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। ভারতীয় দর্শনের সংস্পর্শে এসে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে।সুফিবাদ বিকশিত হয়েছে। সুফিবাদে যে, কৃচ্ছ্বসাধন, জগৎ যে অলীক তা জানা সাধনা প্রভৃতি বেদান্ত ও বৌদ্ধদর্শন হতে গৃহীত বলে তারা মনে করেন। তাছাড়া মুসলমানদের জপমালা ও ধর্ম গ্রহণ পদ্ধতি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণের কাছ হতে প্রাপ্ত বলে নিকলসন মনে করেন।
অভিযোগ খণ্ডন : যে কোন দুটি পৃথক মতবাদের মধ্যে সাদৃশ্য দেখে তাদেরকে আমরা একে অন্য হতে উদ্ভূত বলে বিচার করতে পারি না। কেননা সাদৃশ্যের ভিত্তিতে কার্যকারণ নির্ধারণের প্রয়াশ অনিশ্চয়তামূলক। তাছাড়া দুটি পদ্ধতির মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ কোনক্রমেই মূল পার্থক্যকে দূরীভূত করতে পারে না। কেননা, আমরা দেখি যে, বেদান্তিকরা তাত্ত্বিক দিক থেকে জগৎকে অলীক বা মায়া বলেছেন। অন্যদিকে, সুফি নৈতিক দিক থেকে জগতের অসারতা প্রতিপন্ন করেন। সুফিবাদ মনে করে যে আল্লাহর হুকুম-আহকাম পালন করলো না ও তার প্রেমে ইবাদত করলো না তার কাছে জগৎ অলীক ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু সুফি সাধকের কাছে জগৎ সেরূপ নয়, বরং সে জগতের মোরাকিবার মাধ্যমে খোদার সান্নিধ্য লাভ করে। এ দিক বিচার করলে দেখা যায় যে, সুফিবাদ ও ভারতীয় মরমিবাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়া বলা যায়, সুফিবাদের উৎপত্তি ইসলাম প্রচারের শুরু হতেই । তাছাড়া বলা যায় যে, ভারতীয়।ভাবধারা মুসলমানদের কাছে পৌছার আগেই সুফিবাদের উৎপত্তির হয়েছিল। তাই সুফিবাদ ভারতীয় প্রভাবে উৎপত্তি লাভ করে নি বরং এটি ইসলামের বাতেনি দিক।

সুফিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা : মরমিবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো
Mysticism. দর্শনে এটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। শুধু ভারতে কিংবা ইসলামে আমরা এর বিকাশ দেখি না, বরং কালে কালে, দেশে দেশে আমরা এর উৎপত্তিরও বিকাশ দেখতে পাই। প্রত্যেক সময়ে বা যুগে আমরা এমন এক দল বা গোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পাই যারা ইন্দ্রীয় অবিজ্ঞতার বিশ্বাস করে। তারা আত্মা বিলুপ্তির মাধ্যমে পরম সত্তার সান্নিধ্য লাভ করতে চান। নিম্নে সুফিবাদ ও মরমিবাদের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হলো :
প্রথমত, আমাদের জীবনের রয়েছে দুটি দিক। যথা : ক. পার্থিব ও খ. অপার্থিব। আমাদের জীবনের পরিপূর্ণ ও সার্থক বিকাশের জন্য দৈহিক ও আধ্যাত্মিক, পার্থিব ও অপার্থিব দিক উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুফিগণ মনে করেন ইসলামের দুটি দিক রয়েছে। যথা : ১. বাতেনি দিক, ২. জাহেরি দিক। জাহেরি দিক হলো আচার আচরণের দিক, আর বাতেনি দিক হলো অনুভবের দিক। সুফিগণ এ দুটি দিককে অবিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন। অন্যদিকে, মরমিবাদ অনুসারে এ জগৎ হলো অলীক। তাই তারা দৈনন্দিন প্রয়োজনকে উপেক্ষা করেন, বরং তারা আত্মা নিগ্রহের মাধ্যমে মোক্ষ্যা বা মুক্তি লাভ করতে চান। তবে মনে রাখতে হবে যে, সুফিবাদেও আত্মা নিগ্রহ আছে, তবে সেটি আত্মার বিশুদ্ধতা অর্জনের উদ্দেশ্য যাতে পবিত্র আত্মা পরমসত্তা আল্লাহর দিদার লাভ করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইসলামে যে, সুফি ভাবধারা তার মূল কথা হলো আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ। তবে তারা এ সাধনার পথে জীবন চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ। অর্থাৎ তারা জাগতিক জীবন সম্পর্কে অকর্তব্যপরায়ণ নন। তারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের নানাবিধ ক্রিয়াকর্ম করে গেছেন। তবে তারা একেই জীবনের চরম লক্ষ্য ভাবেন না। মোটকথা, তারা জাগতিক জীবনকে অস্বীকার
করেন না। অন্যদিকে, মরমিগণ বিশেষ করে বেদান্ত ও বৌদ্ধ দর্শনে যে মরমি ভাবধারার কথা বলা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, তারা জীবন বিচ্ছিন্ন ও সংসারত্যাগী সন্ন্যাস জীবন পরিচালনার কথা বলেছেন। একজন সুফি সাময়িকভাবে পরিবর্জন নীতিতে সংসার হতে বিশুদ্ধ হন আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য। তবে এ সময় সার্বজীবনের জন্য নয়। যেমন- বৌদ্ধ
সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা যায়।
তৃতীয়ত, সুফি পরম সত্তা বা আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন সরাসরি। এখানে তৃতীয় কোন ব্যক্তির প্রয়োজন নেই । অন্যদিকে, মরমিবাদে মরমি অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য একজন মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়।
চতুর্থত, সুফিগণ আত্মাবিলোপ নয় বরং আত্মা উপলব্ধির মাধ্যমে আল্লাহকে জানতে চান। অন্যদিকে, মরমিবাদ অনুসারে আত্মেবিলোপের মধ্যমে পরম সত্তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ সম্ভব বলে মনে করেন। তাই দেখা যায় যে, মরমিবাদ ও সুফিবাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য পার্থক্য বিদ্যমান।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুফিবাদ ইসলামের মতো পুরান। এটি যে ভারতীয় প্রভাবে উৎপত্তি লাভ ও বিকশিত হয়ে তা ঐতিহাসিকভাবে ঠিক নয়। নীতিগতভাবেও এটি ঠিক নয়। কেননা ভারতীয় মরমিবাদ ও সুফিবাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। তাই সুফিবাদ ভারতীয় প্রভাবে উৎপত্তি ও বিকশিত হয় নি।