সামাজিক জরিপের বিভিন্ন ধাপসমূহ আলোচনা কর ।

অর্থা, সামাজিক জরিপের বিভিন্ন স্তর বর্ণনা কর।
অথবা সামাজিক জরিপের ধাপগুলোর বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সামাজিক জরিপের স্তরসমূহের ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জরিপ কথাটির অর্থ হচ্ছে কোনকিছু সরেজমিনে পরিমাপ বা নিরূপণ করা। জরিপ নানা ধরনের হতে পারে। যেমন- ভূমি জরিপ, বাজার জরিপ ও মতামত জরিপ ইত্যাদি । একেক জরিপে একেক ধরনের তদন্ত বা পরিমাপ করা হয়। যেমন- ভূমি জরিপে একখণ্ড ভূমি পরিমাপ, কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে তা নিরূপণ করা হয়। তেমনি কোন ঘটনা কিভাবে, কোথায় এবং কেন ঘটল তা সমাজের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে করে দেখা হয় ঠিক সামাজিক জরিপে ।
সামাজিক জরিপের ধাপসমূহ : সামাজিক জরিপের ক্ষেত্রে কতকগুলো পর্যায় বা ধাপ মেনে চলা হয় । নিম্নে সামাজিক জরিপের বিভিন্ন দাপগুলো আলোচনা করা হলো :
১. সমস্যা বা বিষয়বস্তু : কোন জরিপকার্য শুরু করতে হলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হয় তা হলো কোন বিষয়ে জরিপ চালানো হবে তা স্থির করা। এক্ষেত্রে শুধু একটি বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিলেই হয় না, সে বিষয়ের সাথে জড়িত অন্য কি কি বিষয় অনুসন্ধান করা দরকার এবং এসব প্রসঙ্গও এখানে কেন তা দেখতে হবে । উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের নিম্নবিত্ত শ্রেণির বিবাহবিচ্ছেদের হার ও এর আর্থসামাজিক পটভূমি জরিপের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হলো । এখন উক্ত নিম্নবিত্ত শ্রেণির বিবাহবিচ্ছেদ হারের সাথে কি কি আর্থসামাজিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। অতঃপর সেগুলোই হবে জরিপের বিষয় ।
২. সমস্যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা : গবেষণা সমস্যাটি যদি কোন তত্ত্বীয় প্রশ্নের অবতারণা করে তবে তা কি এবং বিরাজমান কোন তত্ত্বের আওতাধীন তা উল্লেখ করতে হবে। এ সম্পর্কে পূর্বে কোন গবেষণা থাকলে তার সংজ্ঞা একে কিভাবে যুক্ত বা আলাদা করা যাবে তা দেখাতে হবে। এর জন্য অনুরূপ গবেষণার কর্মরত ব্যক্তির সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নির্দেশ করা যেতে পারে।
৩. জরিপ প্রশ্নাবলি প্রণয়ন : এ পর্যায়ে একটা সাধারণ প্রশ্নাবলি প্রণয়ন করা হয়, যার উত্তর জরিপ চলাকালীন সময়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে । যেমন-সম্পর্কের আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কি? অথবা শ্রেণি নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সম্পর্কের আয়ের সাথে বসবাসের অবস্থার কি সম্পর্ক? অথবা আরও বেশি নির্দিষ্ট করে জানতে হলে প্রশ্ন করা হয় যে, বসতবাড়ি উন্নয়নের জন্য লোকের মনোভাব কী? এর জন্য কি পরিমাণ নগদ টাকা এবং শ্রম দিতে প্রস্তুত আছে ইত্যাদি ।
৪. জরিপ প্রশ্নাবলির কার্যকারিত যাচাই : তৃতীয় পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত জরিপ প্রশ্নাবলি সরাসরিভাবে জরিপে ব্যবহার করা যায় না ! কৌশল ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এরূপ ধারায় এগুলোকে রূপান্তর করা হয়। বিষয়বস্তুকে অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে এবং তথ্যের উৎসসমূহের নির্দেশনা দিতে হবে। যখন উত্তরদাতা থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তখন ভৌগোলিক এলাকা এবং জরিপ সম্পর্কের পরিচয় তুলে ধরা হয়। প্রশ্নামালার কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য এসব প্রশ্নমালার সাহায্যে প্রাথমিক জরিপকার্য চালানো হয় ।
৫. প্রাপ্ত সম্পদের সঙ্গত ব্যবহার : তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে জরিপের নকশা, সময়, জনশক্তি এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ইত্যাদি দ্বারা এর উদ্দেশ্যাবলির যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা প্রভাবিত হয়। জরিপের সময়, অর্থ ও সহকর্মীবৃন্দ সচরাচর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই জরিপের নকশা, তথ্যসংগ্রহের পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতা এবং প্রাপ্ত অর্থ ও সময়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিত । অন্যথায় জরিপ কার্য চালানো কষ্ট হয়ে দাঁড়ায় ।
৬. তথ্যসংগ্রহের পদ্ধতি নির্ধারন : উপযোগী জরিপ পদ্ধতি নির্ধারণ দীর্ঘ নীতিমালার উপর নির্ভরশীল । একটি প্রকৃত তথ্য সং গ্রহ পদ্ধতি নির্ধারণের ব্যাপারটা নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের উপর নির্ভরশীল । যেমন-
ক. জরিপের উদ্দেশ্যের দিক লক্ষ্য রেখে পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। অনুসন্ধানমূলক হলে একরকম পদ্ধতিতে
খ.জরিপ চালাতে হবে এবং বর্ণনামূলক হলে অন্যরকম পদ্ধতিতে জরিপ কার্য চলাতে হবে ।
গ.তথ্যসংগ্রহের জন্য প্রাপ্ত সময় এবং অপরপক্ষে তথ্যসংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে । তথ্যসংগ্রহের জন্য প্রাপ্ত অর্থ অপরপক্ষে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতির ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।
৭. গবেষণা পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন : জরিপের কাজ শুরুর আগে গবেষণাটির পূর্ণাঙ্গ দিকসমূহ কিভাবে নির্ধারণ করা হবে সে সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা বা নকশা দরকার। সেজন্য গবেষণা নকশা প্রণয়ন জরিপ পদ্ধতির একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তর । কম সময়, অর্থ ও শ্রম ব্যয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পূর্ব পরিকল্পনাগত ব্যবস্থাকে গবেষণা নকশা বলা হয় ।
৮. তথ্য সংগ্রহ : এটি একটি সময় সাপেক্ষ স্তর যা উত্তম রূপে তদারক করা প্রয়োজন । সমস্যা সম্পর্কে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল জ্ঞানচর্চা করার জন্য তথ্যসংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এ সামাজিক জরিপে তিন ধরনের পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় । পদ্ধতি তিনটি নিম্নরূপ : ক. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, খ. সাক্ষাৎ পদ্ধতি এবং গ. প্রশ্নমালা পদ্ধতি ।
৯. তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ : তথ্যসংগ্রহের পর সর্বপ্রধান পদক্ষেপ হলো সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা। তথ্যগুলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন তথ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ । তথ্য সংগ্রহ করার সময় অনেক যুক্তিহীন তথ্য চলে আসতে পারে। তাই জরিপের লক্ষ্যানুযায়ী ব্যবহারযোগ্য তথ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে তথ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রয়োজন ।
১০. তথ্যের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা : জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার জন্য তথ্য পরিশোধনের পর স্বল্পাকারে বা সারাংশ আকারে এর সংকলন কাজ শেষ করাকে বিশ্লেষণ বলে। যে ধরনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হোক না কেন, তথ্যের গুণগত মানের প্রেক্ষিতে জরিপ ফলাফল মূল্যায়ন করা উচিত ।
১১. ফলাফল উপস্থাপন : জরিপের শেষ পর্যায় হলো ফলাফল প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করা। জরিপের উদ্দেশ্য দ্বারা প্রতিবেদনের সূচিপত্র বহুল পরিমাণে নির্ধারিত হয়। প্রতিবেদনের গঠন, কাঠামো উপস্থাপনা ও লেখার ভঙ্গি নির্ভর করে এক ধরনের লোকের উপর যাদের জন্য প্রতিবেদন লেখা হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে কোন সামাজিক গবেষণার তথ্যসংগ্রহের জন্য জরিপ দবিচেয়ে ভালো পদ্ধতি। তবে বাংলাদেশের মতো নিরক্ষর সমাজে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা খুবই কষ্টকর । কিন্তু আধুনিক সমাজে এ পদ্ধতির ব্যবহার খুবই ফলপ্রসূ।