General Knowledge

১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন সম্বন্ধে যা জান লিখ ।

উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শাসন শোষণ বিশেষ করে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ও দমননীতির প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে ছাত্রদের দ্বারা যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তা ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৬২ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলো গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাষট্টি সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন বিশেষভাবে ‘শিক্ষা আন্দোলন’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলনের ফলে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে ওঠে তা পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিকশিত হয়।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : নিচে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো :
১. শিক্ষা পটভূমি : ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন আইয়ুব বিরোধী শিক্ষা আন্দোলন নামে বিখ্যাত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতি এ অঞ্চলের ছাত্রসমাজকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান সরকার মনে করেছিল পূর্ব বাংলায় শিক্ষার অগ্রগতি রোধ করতে পারলে এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ স্তিমিত হবে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের ভিত্তি দীর্ঘকাল টিকে থাকবে। উলেখ্য ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৬১-৬২ সাল পর্যন্ত শিক্ষাখাতে পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করার পরও সরকার ১৯৬২ সালের শেষদিকে পাকিস্তানের যে নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করে তাতে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার নিম্নগতিকে আরো ত্বরান্বিত করার কৌশল অনুসরণ করা হয়। ফলে এ অঞ্চলের ছাত্রসমাজ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।
২. রাজনৈতিক পটভূমি : পাকিস্তান রাষ্ট্রে নামেমাত্র গণতন্ত্র চালু থাকলেও ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির সাথে সাথে তারও অবসান ঘটে। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পরপর সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত রাজনীতির উপর এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। উলিখিত সময়ে বাংলার ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক নেতাদের শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে।
ডাকে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের কারণ : নিচে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের কারণ আলোচনা করা হলো :
১. সোহ্রাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার : ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী করাচি সফরে গেলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। সোহ্রাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের খবর পরদিন পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে এবং সোহ্রাওয়ার্দীর মুক্তির দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
২. সামরিক শাসন জারি : ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই সামরিক শাসন জারি করেন। এ সিদ্ধান্তটি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করেছিল। ফলশ্রুতিতে সংঘটিত হয়েছিল ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন।
৩. সরকারের বৈষম্য নীতি : পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কখনই চাইত না পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী শিক্ষিত হোক, সচেতন হোক। এজন্য তারা যত রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা পিছিয়ে পড়বে তা গ্রহণ করতো। এসব বৈষম্যমূলক মনোভাবের জবাবে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।
৪. রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার : সামরিক শাসন জারির পরপরই আইয়ুব খান উল্লেখযোগ্য সকল নেতাদের গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের রাজনীতিকে নেতৃত্ব শূন্য করেছিলেন। এমতাবস্থায় রাজনীতিকদের অনুপস্থিতিতে দেশের ছাত্রসমাজ তাদের দায়িত্ব মনে করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল।
৫. শরিফ কমিশনের রিপোর্ট : ১৯৬২ সালে শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এখানে সর কারি ব্যয় কমিয়ে ছাত্রদের ব্যয়ে লেখাপড়া চালানোর ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হয়। যেটা কার্যকর করলে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় ছাত্ররা তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় ১৯৬২ সালের শিক্ষা
আন্দোলন শুরু করেছিল।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় : নিচে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়গুলো তুলে ধরা হলো :
১. সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহ্রাওয়ার্দী করাচি সফরে গেলে তাকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সফরে এলে ছাত্ররা তাকে নাজেহাল করে। ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ
ঘোষণা করে এবং বহু ছাত্র নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় ধর্মঘট ও হরতাল অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
২. শাসনতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন : রাষ্ট্রের ছাত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনা ঘটে আইয়ুব খান প্রণীত শাসনতন্ত্রকে কেন্দ্র করে। ১৯৬২ সালে প্রণীত সংবিধানকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে এবং গভর্নর মোনায়েম খানকে নাজেহাল করে। মোনায়েম খান কৌশলে বহু ছাত্র নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের উপর নির্যাতন চালায়। ২৫ জুন ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় নয় জন রাজনীতিবিদ সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন যার ফলে আইয়ুব খান পরবর্তীতে ছাত্র নেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
৩. শরিফ কমিশন বিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালে শরিফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় এ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ছাত্ররা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ছাত্রদের মধ্যে এ কমিশনের রিপোর্টের ব্যাপারে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
১৯৬৩-৬৪ সালের ছাত্র আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা ১৯৬৩ সালের প্রথম থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। আইয়ুব ও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করতে মোনায়েম পেশাদার বাহিনী হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল ছাত্র ফেডারেশন গঠন করেন। ১৯৬৩ সালে ফেডারেশন গঠনের পরপরই এ বাহিনী শুধু ছাত্রদের উপরই নয়। শিক্ষক, কর্মচারীদের উপরও ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। ছাত্ররা প্রথম থেকেই মোনায়েম খানকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ১৯৬৩ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি রংপুরে গেলে স্টেশনেই ছাত্ররা তাকে প্রবেশে বাধা দেয়। কনভেনশন মুসলিম লীগ পন্থিরা ছাত্রদের বাধা দিলে সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়। আইয়ুব ও মোনায়েম বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৯৬৩ সালের প্রথম তিন মাসে পাইকারি হারে ছাত্রদের গ্রেফতার ছাড়াও কলেজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকার কলেজ ম্যানেজিং কমিটিসমূহের কাছে গোপন সার্কুলার পাঠায়। যদিও এ উদ্যোগ তেমন সফল হয়নি। চরম দমননীতি সত্ত্বেও ১৯৬৩ সালে ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস পালন করে। ছাত্রদের আর লেখাপড়া শিখে লাভ নেই। ফ. কা. চৌধুরীর এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এ আন্দোলন করাচিতেও পৌঁছে এবং অনশন ও ধর্মঘট হয়। আইয়ুব ও মোনায়েম বিরোধী আন্দোলন
৬৩ সালের মাঝামাঝির মধ্যেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, ছাড়া ও পটুয়াখালী, চাঁদপুরে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্ররা শিক্ষা দিবস মহাসমারোহে পালন করে। যদিও ছাত্রদের কর্মসূচিতে কোথাও কোথাও পুলিশ বাধা দেয়।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব : নিচে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন : ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পরপরই সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ও রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেন। এমতাবস্থায় ছাত্ররা আন্দোলন করে এটা প্রমাণ করে দেয় যে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বেশিদিন চলবে না।
২. সংগঠিত আন্দোলন : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট প্রভৃতি ছাত্র সংগঠন। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে যা পরবর্তী আন্দোলনগুলোতে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে সাহায্য করেছিল ।
৩. স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান শক্তি : এ আন্দোলনের মাধ্যমে পরবর্তীকালীন সকল আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসেবে রূপান্তরিত হয় বাংলার ছাত্রসমাজ। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তিই ছিল বাংলার ছাত্রসমাজ।
৪. আইয়ুব খানের প্রথম পরাজয় : ১৯৬২ সালের ছাত্রদের দাবির মুখে আইয়ুব খান শরিফ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাহারে বাধ্য হন। যেটা লৌহমানব আইয়ুব খানের কোনো বিষয়ে প্রথম পরাজয় ছিল।
৫. এগারো দফার ভিত্তি : ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এগারো দফা আন্দোলনের ভিত্তিস্বরূপ। এ আন্দোলনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও এগারো দফা দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে ছাত্রসমাজ গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, শিক্ষা সংকোচন, শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করে এ রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা ব্যাপক প্রচারণা, সভা, সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট চালিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে এ আন্দোলন সমগ্র প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!