General Knowledge

১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বিবরণ দাও।

অথবা, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অন্যতম হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এ দলটির অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত এ দলটির মাধ্যমে বাঙালি পেয়েছিল মুক্তির দিশা, পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচার উপায়। এ দলটি একদিনে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়নি বরং এ দলটির প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কারণ/পটভূমি : নিচে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উলেখযোগ্য কারণসমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. মুসলিম লীগের উদারপন্থি নেতৃবৃন্দকে অবহেলা : ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যথাসম্ভব ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা। এ দলটির অধিকাংশ নেতা ছিল জমিদার শ্রেণির। সাধারণ মানুষের সাথে এদের সদ্ভাব বজায় ছিল না এবং এরা উদারপন্থি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ যেমন- হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখকে প্রচণ্ডভাবে অবহেলা করত। ফলে এসব উদারপন্থি নেতৃবৃন্দ মিলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।
২. মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম : গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল অত্যাবশ্যক। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিতপর যেসব দল বিদ্যমান ছিল মুসলিম লীগ তাদেরকে নানাভাবে ভারতের দালাল হিসেবে আখ্যায়ি করত। এমনকি যারা মুসলিম লীগের সমালোচক ছিল তাদেরকে পার্লামেন্ট হতে অপসারণ করতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করত। ১৯৪৯ সালের উপনির্বাচনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নির্বাচিত হলেও তৎকালীন গভর্নর তার প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা করে।
৩. মুসলিম লীগের দলীয় কোন্দল : মুসলিম লীগে নানা উপদল বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে একদল ছিল উদারপন্থি আর অন্যদল ছিল রক্ষণশীল। রক্ষণশীলরা নানাভাবে উদারপন্থিদের উপর নিপীড়ন চালাতো। তাদের এ দমননীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে দলের উদারপন্থি অংশ ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনে উদ্যোগী হয়।
৪. পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য : মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা নানাভাবে পূর্ব বাংলাকে শোষণ করত। ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পৃথক একটি দল গঠনে উদ্যোগী হন।
৫. বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা : উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা বাঙালিদের প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ ও বিস্মিত করে তোলে। তারা বুঝতে পারে, একটি সুনির্দিষ্ট দল গঠন ব্যতীত তাদের ন্যায্য দাবি কখনো পূরণ হবে না। তাই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন একটি দল গঠনে উদ্যোগী হয়।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বিবরণ : ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক অংশের
নেতা কর্মীদের এক কনভেশনে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এ দলটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন ও আলী আমজাদ খানকে সহসভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ. কে. রফিকুল ইসলাম যুগা সাধারণ সম্পাদক, ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ অসাম্প্রদায়িক। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর তৃতীয় কাউন্সিল সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হিসেবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগই ছিল প্রধান বিরোধী দল। দলটি জন্মলগ্নেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি, এক মানুষ এক ভোট, গণতন্ত্র, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি। ১৯৪৮-৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ এবং এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পূর্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচিসমূহ : নিচে আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচিসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. পাকিস্তানকে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ থাকবে।
২. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের দুটি ইউনিট থাকবে।
৩. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে।
৪. সরকারি আমলারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাতা পাবে না এবং তাদেরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে না।
৫. সরকারি কর্মচারীরা সমালোচনার সম্মুখীন হবেন এবং তাদের অপরাধের বিচার করা হবে।
৬. সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার যেমন- চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রদান করা হবে।
৭. সকল নাগরিকের জন্য পেশা নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হবে।
৮. সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
৯. প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সকল যোগ্যতাসম্পন্ন নাগরিকের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে এবং সকল নাগরিকের জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
১০. কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা যাবে না।
১১. বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হবে এবং সকল মধ্যস্বত্বভোগ বিলোপ করা হবে।
১২. সকল জমি জাতীয়করণ করা হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আওয়ামী মুসলিম লীগ মূলত মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে এসে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করে। পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ গঠন করা হয়। যে দলের প্রভাব আজও স্বীকৃত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!