General Knowledge

হেনরী লুইস মর্গান পরিবার সম্পর্কে যে বিবর্তনবাদী মতবাদ দেন তা বিস্তারিত আলোচনা কর ।

অথবা, পরিবার সম্পর্কে মর্গানের বিবর্তনবাদী মতবাদ বিস্তারিত আলোচনা কর।
অথবা, পরিবার সম্পর্কে প্রদত্ত হেনরী লুইস মর্গানের বিবর্তনবাদী মতবাদ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পরিবার একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। এটি সমাজের ক্ষুদ্রতম একক। মানবসমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, পরিবার সবচেয়ে মৌলিক প্রতিষ্ঠান। সমাজকে পরিবার ব্যতিরেকে কল্পনা করা সম্ভব নয়, পরিবার হলো সমাজের একটি মৌলিক ইউনিট। জীবদেহ যেমন বিভিন্ন কোষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, তেমনি পরিবারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সমাজ।
Top পরিবারের উৎপত্তি সংক্রান্ত মর্গানের তত্ত্ব : হেনরী লুইস মর্গান একজন প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী । তিনি পরিবার সম্পর্কে দীর্ঘদিন গবেষণা করেন এবং এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মত দেন। নিম্নে মর্গানের পরিচয় ও পরিবার সম্পর্কে তার মতামত বিস্তারিত বর্ণিত হলো :
পরিবার সম্পর্কে মর্গানের মতবাদ : পূর্বেই বলা হয়েছে মর্গান বেড়ে উঠেছেন এমন পরিবেশে যেখানকার আশেপাশে ইরোকোয়া জাতি গোষ্ঠী বাস করতো। তাদের জীবনযাপন ছিল অন্যদের তুলনায় স্বতন্ত্র। তার ছিল বিশেষ আগ্রহ এ জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রতীক । গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি ‘গার্ডিয়ান নট’ নামক গোপন সমিতিতে যোগদান করেন। এ সংগঠনের অভিষেক হয় ইরোকোয়াদের উৎসবের অনুকরণে যেখানে সকলেই পালকের সজ্জায় সজ্জিত হয়ে উৎসবে যোগ দেয়। এ অনুষ্ঠান তার চিন্তাজগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ এতে বৃদ্ধি পায়। এ লক্ষ্যে তিনি শুধু স্থানীয় নয়, অন্যান্য অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে ব্যাপক তথ্যসংগ্রহ করতে থাকেন। এ প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থেকে তিনি ১৮৬৮ সালে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যার নাম “সিস্টেম অব কনস্যাঙ্গুইনিটি এন্ড এফিনিটি অব দ্যা হিউম্যান ফ্যামিলি।” গ্রন্থটি বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ গ্রন্থে তিনি বিবর্তনবাদী ধারায় জাতিগোষ্ঠীর যে পরিবর্তিত রূপ তা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে দক্ষতার পরিচয় দেন।
পরিবার সম্পর্কিত বিবর্তনবাদী মতবাদ : ১৮৭৭ সালে মর্গানের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘Ancient Society’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় । এ গ্রন্থে তিনি মানবসমাজের বিবর্তনকে তিনটি শাখায় বিভক্ত করেছেন :
১. আদিম সমাজ, ২. বর্বর যুগ, ৩. সভ্যতার যুগ। বিবর্তনের ধারায় তিনি পাঁচ ধরনের পরিবারের কথা বলেছেন। এদের একটির সাথে অন্যটির সামঞ্জস্য বা কোন প্রকার মিল নেই । এ পরিবারগুলো প্রতিটিই স্বতন্ত্র। নিম্নে তা বর্ণিত হলো :
১. স্বগোত্রীয় ভাইবোনের বিবাহভিত্তিক পরিবার : মর্গানের মতে, “এ ধরনের পরিবার প্রাচীন বা আদিম প্রকৃতির। বর্তমানে এ ধরনের পরিবার উপজাতিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। বর্বর যুগে এ ধরনের পরিবারের প্রমাণ পাওয়া যায় । এ ধরনের পরিবার গঠিত হতো স্বগোত্রীয় ভাই ও বোনের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে। এটি করা হতো বংশের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য । এ ধরনের পরিবার গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞাতি সম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী করা।”
২. দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার : মানবসমাজের অগ্রগতির উন্নত সংস্করণ হলো দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার। আপন ভাইবোনের বিবাহের ফলে যেসব শারীরিক ও আত্মিক অসুবিধা দেখা দেয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা থেকে এ ধরনের বিবাহের উৎপত্তি বলে মর্গান মনে করেন। এ ধরনের পরিবার ব্যবস্থায় দুই বা ততোধিক ভাই এবং দুই বা ততোধিক বোন একসাথে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ভিত্তিতে বসবাস করে।
৩. জোড়া এবং এ ধরনের বিয়ের উপর ভিত্তি করে যে পরিবার গড়ে উঠে তা হলো জোড়া বিয়ে পরিবার বা সীনড্যাসমীয় পরিবার । আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে যারা বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়ে ছিল তারা এ ধরনের পরিবার গঠন করেছিল। এ ধরনের পরিবার ব্যবস্থায় কয়েক জোড়া পরিবার একসাথে বসবাস করতো।
৪. পিতৃপ্রধান পরিবার : প্রাচীন সেমেটিক গোষ্ঠীর মধ্যে পিতৃপ্রধান পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পরিবারের প্রধান ছিল পুরুষ। পুরুষ তার ইচ্ছানুসারে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারত। তবে পিতৃপ্রধান পরিবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কর্তা যেখানে স্ত্রীর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। এখানে পুরুষ বা পিতা তার অনুগত ব্যক্তিদের প্রতিও পুরুষ ছিল পরিবারের
মূল কর্তৃত্ব করতো। এখানে পিতাই ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
৫. এক বিয়ে পরিবার এক বিয়ে পরিবার গড়ে উঠে এক স্বামী ও এক স্ত্রী নিয়ে এবং তাদের দ্বারা গড়ে উঠে পারিবারিক জীবন। এ ধরনের পরিবারে কিছু চাকর চাকরানি থাকলেও তারা দম্পতির কর্তৃত্বের অধীন থাকে। প্রাচীন হিব্রু, ল্যাটিন ও গ্রিক সমাজে এ ধরনের পরিবারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মর্গান মনে করেন, “বর্বর যুগের শেষ পর্যায়ে এ ধরনের এক বিয়ে পরিবার স্থায়ী রূপ লাভ করে।”
সমালোচনা : বিবর্তনবাদী চিন্তাবিদ ও নৃবিজ্ঞানী হেনরী লুইস মর্গান বিবর্তনবাদের আলোকে পরিবারের প্রকারভেদ করেন কিন্তু অনেকে তার সাথে একমত নন। বিশেষ করে যারা ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানী তারা। তারা বলেছেন যে, ভাইবোনের মধ্যে বিবাহটি মর্গানের অবাস্তব কল্পনা। এ সম্পর্কে তিনি কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ দিতে পারেন নি। নৃবিজ্ঞানী ম্যালনেস্কী বলেছেন, “প্রকৃতিতে আমরা দেখি যে, পশুপাখি এক জোড়ার মধ্যে যৌনসঙ্গম করে এবং একসাথে ঘুরে বেড়ায়।” ফলে মর্গানের তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা চলে যে, পরিবারকে সামাজিক সংগঠন হিসেবে অস্বীকার করা চলে না, এমন কোন সমাজব্যবস্থা ছিল না, যেখানে কোন পরিবার ছিল না। অর্থাৎ সকল সমাজেই পরিবার ছিল। তবে পরিবারের প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। মর্গান পরিবারের প্রভেদ করেছেন বিবর্তনের নীতি অনুসরণ করে। আর এজন্য তিনি বিবর্তনবাদী নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!