• March 28, 2023

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের কোনো ভূমিকা ছিল কী? বর্ণনা কর।

অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় তার গভীর প্রভাব ফেলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বপ্রথম বিজয় গৃহীত হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার জনগণের উপর যে স্বৈরাচারী অপশাসন শুরু করে তার বিরুদ্ধে বাংলার প্রতিবাদী জনতা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে দাবি আদায়ের তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের বিজয় মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ভূমিকা : ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নিচে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিকা উল্লেখ করা হলো :
১. বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথম বাঙালিদের বিজয় সূচিত হয়। এ বিজয়ের পথ ধরেই বাঙালি অধিকার সচেতন হয় এবং স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
২. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যব হয়ে মুসলিম লীগের বিপক্ষে রায় প্রদান করে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি
হয় তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
৩. মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় : মুসলিম লীগ সরকার ছিল গণবিচ্ছিন্ন। মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ ন্যায্য অধিকার আদায়ে যুক্তফ্রন্টকে ভোট প্রদান করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল পূর্ব বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি ও গণদাবি। এ নির্বাচনে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়, যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জাগরণ : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী মহল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। তারা জনগণের ন্যায্য অধিকার দিতে নারাজ। ফলে পূর্ববাংলার জনগণ তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হতে থাকে এবং বাঙালির চিন্তা চেতনায় এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তার জাগরণ ঘটে। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে এ চেতনা কাজ করেছিল ।
৫. যুক্তফ্রন্টে বিজয় : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পূর্ব বাংলার জনগণের মাঝে স্বাধীনতার বীজবপন করেছিল। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে জোট গঠিত হয় তা স্বাধীনতার আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল। যুক্তফ্রন্টের বিজয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ অবদান রাখে।
৬. বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রদান : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ২১ দফা কর্মসূচির প্রথম দফাই ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা, যা পূর্ববাংলার জনগণের প্রাণের দাবি ছিল। নির্বাচনি ফলাফল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যাওয়ায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের কথা বুঝতে পারে। যার প্রেক্ষিতে গণপরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়। এ বিজয় পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
৭. স্বায়ত্তশাসনের দাবি : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়। পাকিস্তানি সরকার পূর্ব বাংলায় অধিকতর সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে রাজনৈতিক দমন ও নিপীড়ন সৃষ্টি করে। যার ফলে বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।
৮. প্রতিনিধিত্বশীল গণপরিষদ : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল গণপরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে যে সকল জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে তারা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়। এর ফলে নেতৃত্বে বিকাশ ঘটে, যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
৯. রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় রাজনীতিতে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক সচেতনতা পরবর্তীতে দাবি আদায়ে ও ন্যায় অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ রাজনৈতিক সচেতনতা পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
১০. গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ : যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনই পাকিস্তানের প্রথম অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচন। গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ বিকাশের ফলে পূর্ববাংলার জনগণ স্বাধীনতা লাভে অগ্রসর হয়।
১১. স্বাধীনতা অর্জন : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেও যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের কারণে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার মতামতকে অগ্রাহ্য করে। ফলে দেশবাসীর মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ২৪ বছরের বৈষম্য, দমন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে এবং জন্ম হয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য একটি মাইলফলক। এ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে যে চেতনা, আদর্শ, জাতীয়তাবাদ, ঐক্য ও সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি হয়
তার চূড়ান্ত পরিণতিতে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেই বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের
অভ্যুদয়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ad%e0%a6%be%e0%a6%b7%e0%a6%be-%e0%a6%86%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a6%e0%a7%8b/
পরবর্তী পরীক্ষার রকেট স্পেশাল সাজেশন পেতে হোয়াটস্যাপ করুন: 01979786079

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!