অথবা, ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনাটি বর্ণনা কর।
অথবা, সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রস্তাবটি কী ছিল?
অথবা, অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াসে বসু সোহরাওয়ার্দীর চুক্তির ধারাগুলো লিখ।
অথবা, অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ।
অথবা, বসু-সোহ্রাওয়ার্দী চুক্তি কী? এই চুক্তির শর্ত কী ছিল?
অথবা, বসু-সোহ্রাওয়ার্দী চুক্তি কী?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তিকরণ যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, এমন এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম ও অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। যদিও এ ঘোষণা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কিছু উচ্চাভিলাষী নেতৃবৃন্দের কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনা : বাংলার ভবিষ্যৎ প্রশ্নে আলোচনার জন্য তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ২৭ এপ্রিল ১৯৪৭ দিল্লিতে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে আলোচনা করেন। উক্ত আলোচনার পরপরই সোহ্রাওয়ার্দী দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ প্রস্তাবে বলা হয় যে, বাংলায় এক নতুন মন্ত্রিসভা থাকবে যার প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান। মন্ত্রিসভায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ হিন্দু ও পঞ্চাশ ভাগ সদস্য মুসলমান হবেন। তারা প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন।
তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দ যুক্ত বাংলার সপক্ষে মতামত প্রদান করেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার কাঠামো কেমন হবে সে সম্পর্কে হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের ১৯৪৭ সালের ৩০ এপ্রিলের সভায় মওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে একটি সাবকমিটি গঠিত হয়। এসব
কমিটির সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, ইউসুফ আলী চৌধুরী প্রমুখ। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উদ্যোগের প্রতি শরত্বসুসহ অনেক হিন্দু নেতৃবৃন্দ ইতিবাচক সাড়া প্রদান করেন। অখণ্ড স্বাধীন বাংলার গঠন নিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী ও শরৎ নীতি-পরিকল্পনা নিয়ে ১২-২০ মে হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্যাপক আলোচনা করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোহ্রাওয়ার্দী (বাংলার মুখ্যমন্ত্রী), আবুল হাশিম (প্রাদেশিক লীগ সেক্রেটারী), মোহাম্মদ আলী (বগুড়া, মন্ত্রী), ফজলুর রহমান (ঢাকা, মন্ত্রী), এ এম মালিক, কিরণশঙ্কর রায় (বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা), সত্যরঞ্জন বখশী, শরৎচন্দ্র বসু (ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ শরৎচন্দ্র বসুর ১নং উডবার্ন পার্ক, কোলকাতার বাসভবনে এক সম্মেলনে অখণ্ড বাংলার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর খসড়া রচনা করেন। এটিই ঐতিহাসিক ‘সোহ্রাওয়ার্দী-বসু প্রস্তাব/চুক্তি’ নামে পরিচিত।
বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি : নিচে বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তি সম্পর্কে বা এ চুক্তির মূল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারতের বাকি অংশের সাথে এ রাষ্ট্রের সম্পর্ক কিরূপ হবে, তা সে নিজেই নির্ধারণ করবে।
২. হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা অনুপাতে আসন সংখ্যা বণ্টন করে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আইনসভার নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু ও তফশিলি হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে অথবা উভয়ের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আসন বণ্টন করা হবে। নির্বাচন হবে একটি এলাকা থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনমূলক এবং ভোট হবে বণ্টনধর্মী, সর্বোচ্চ আসন সংখ্যাভিত্তিক নয়। কোনো প্রার্থী যদি তার নিজ সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ পান এবং অন্য সম্প্রদায়ের ২৫ শতাংশ প ান তাহলে তিনি নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন।
৩. স্বাধীন বাংলার এরূপ পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকার মেনে নিলে কিংবা বাংলা বিভক্ত হবে না এরূপ ঘোষণা দিলে বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হবে এবং চিফ মিনিস্টার পদ বাদে সমসংখ্যক হিন্দু ও মুসলিম সদস্য নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। এ মন্ত্রিসভার চিফ মিনিস্টার হবেন একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
৪. নতুন সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত চাকরি ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমান অধিকার থাকবে। এসব চাকরিতে কেবল বাঙালিদের অধিকার থাকবে।
৫. ইউরোপীয় সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে বঙ্গীয় আইনসভায় ৩০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। মুসলমান ও অমুসলমানদের সংখ্যা হবে যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ জন।
উপসংহার : আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অবিভক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনা ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফল। যদি তৎকালীন সময়ে অবিভক্ত বাংলা গঠনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হতো তাহলে হয়তো উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতো।

admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!