অথবা, মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি কী? সামাজিক পরিবর্তনে এ তত্ত্বের নিয়ামকসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতা মানবসমাজের ধর্ম। সামাজিক পরিবর্তন বলতে অনেকে স্থায়ী সামাজিক ব্যবস্থার শুধু একটি প্রয়োজনীয় অংশের পরিবর্তনকে বুঝায়। আবার অনেকে মনে করেন সামাজিক পরিবর্তন হলো গোটা সমাজব্যবস্থারই পরিবর্তন। তবে এ বিষয় নিয়ে যতই মত পার্থক্য থাকুক না কেন; একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন (Social change) সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় প্রত্যয়। সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কিত মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব (Marx historical Materialism as social change) : বিশিষ্ট সমাজ চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও দার্শনিক কার্ল মার্কস ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ ব্যক্ত করেন। মার্কসের মতে, “ইতিহাসের গতিপথ অর্থনৈতিক উপাদানের দ্বারাই পরিবর্তিত হয়।” নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. উৎপাদনের দুটি দিক : উৎপাদনের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো উৎপাদন শক্তি, শ্রমিক ও তার শ্রম ক্ষমতা, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি উৎপাদন শক্তি, দ্বিতীয়টি হলো উৎপাদন সম্পর্ক। এটি হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে তথা শ্রেণীতে শ্রেণীতে উৎপাদনভিত্তিক পারস্পরিক সংযোগ বা সম্পর্ক।
২. সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি : মার্কসের মতে, উৎপাদনের উপাদানগুলো যখন যে শ্রেণীর হাতে থাকে, তখন সে শ্রেণী সমাজে প্রাধান্য লাভ করে এবং সেভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়।
৩. উৎপাদন ব্যবস্থা শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টি করে : উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজকে পুঁজিপতি ও প্রলেতারিয়েত এ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে। ফলে প্রলেতারিয়েত শ্রেণী শ্রেণীসংগ্রাম শুরু করে, অবশেষে শ্রেণীসংগ্রামের অবসান ঘটে এবং শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠে।
৪. দাস সমাজ : দাস যুগে আদিম সমাজব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত উৎপাদন শক্তিসমূহ অধিকতর উন্নত হয়। দাসদের নির্মমভাবে শোষণ করা হতো। তারা ছিল সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ সমাজে দাস মালিকরাই ছিল উৎপাদনের উপকরণ এবং দাসদের মালিক। পরবর্তী সময়ে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং দাসদের বিদ্রোহের ফলে দাস সমাজ ভেঙে গড়ে উঠে সামন্ত সমাজ।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা (Explanation of historical materialism) : মার্কসীয় বস্তুবাদের মূলকথা হলো বস্তুই মৌল এবং মন ও সচেতনতা গৌণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অনন্ত ও সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি নয়, সময় ও বিস্তৃতিতেও তা অনন্ত। অতএব, সচেতনতা গড়ে উঠেছে বস্তুর ভিত্তিতে। মার্কসের মতে, “বৃহত্তর সংজ্ঞা অনুযায়ী বস্তু বলতে অবজেকটিভ বাস্ত
বতার প্রত্যক্ষণকে বুঝায়।” লেনিনের বক্তব্য অনুযায়ী মার্কসীয় বস্তুবাদে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত বস্তুজগৎ, যার মধ্যে আমরা বসবাস করছি তাই হলো একমাত্র বাস্তব। এখানে অতীন্দ্রিয় কোন সত্তার সাহায্যে বস্তুজগৎকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়েছে। উপরন্তু এ বস্তুজগতের অস্তিত্ব সমাজের মানুষের উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ বস্তুজগৎ সমাজের ঊর্ধ্বে কিন্তু সমাজ বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে নয়, বরং সামাজিক চিন্তাচেতনা বস্তুজগৎ নিঃসৃত। মার্কসীয় মতে, বস্তুই প্রাথমিক, চেতনা পরবর্তী সময়ের। ভাববাদীদের বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কস বলেছেন, “চিন্তা কল্পনাপ্রসূত নয় বা আকাশ থেকে আসে না; অভিজ্ঞতার আলোকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবেই চিন্তার প্রতিফলন ঘটে।” সমাজ নিজেই একটি বস্তু। সমাজের বাস্তব অবস্থা থেকে সামাজিক চেতনার সৃষ্টি। এ সামাজিক চেতনা ও চিন্তা গড়ে উঠেছে সামাজিক অভিজ্ঞতার আলোকেই। তাই সামাজিক অভিজ্ঞতা অজ্ঞেয ় নয়। কেননা সমাজ বস্তুর প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে সামাজিক অভিজ্ঞতা, কালক্রমে যা সঞ্চিত
হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারে। মার্কসীয় মতবাদে বস্তুবাদী ব্যাখ্যার নিমিত্তে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে যে, কোন বস্তুর বিশ্লেষণ অন্য বস্তুর থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে করা যায় না। কেননা পৃথিবীর কোন বস্তুরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সমালোচনা (Criticism on historical materialism) : মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে তেমনি আবার সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। নিম্নে সেগুলো উপস্থাপন করা হলো :

  1. জন প্ল্যামেনাজ বলেছেন, “Marx when he called his theory historical materialism deceived
    froot both himself and his readers.”
    মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ একটি অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা, কারণ অর্থনৈতিক উৎপাদন ছাড়াও অন্যান্য উপাদান যেমন- ধর্ম, ভাষা কিংবা কোন নেতার প্রভাবে একটি জাতির ইতিহাস পরিবর্তিত হতে পারে। মার্কস তাঁর আলোচনায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি বাদ দিয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধদেব, যিশুখ্রিস্ট, হযরত মোহাম্মদ
    (স) এর কার্যাবলির পিছনে কোন অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। বর্তমানকালে পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদীর মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে তার মূলে অর্থনীতি নয়। অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “শুধু অর্থনীতির আলোকে ইতিহাসের ব্যাখ্যা মেনে নেয়া যায় না।” তাঁর এ মতবাদ একটি অস্পষ্ট ও সংগতিহীন মতবাদ। কারণ এ মতবাদের আলোচনা বস্তুবাদের আলোচনায় পড়ে না, বরং ইতিহাসের অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা বলা যায়।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ছাড়া সামাজিক পরিবর্তনের কোন বাস্তব ও যুক্তিসংগত মতবাদ কার্ল মার্কস ব্যতীত অন্য কোন দার্শনিক দিতে পারে নি। এ সম্পর্কে অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “সামাজিক বিবর্তনের রহস্য জানতে হলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ একমাত্র উপায়।” পুঁজিপতিদের শোষণের মুখোশ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারা খুলে যায়। পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারাই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার তাগিদ প্রলেতারিয়েতরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকেই পেয়েছে।
https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a6%b6%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ac/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!