সামাজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানবসমাজের বাইরে স্বাভাবিক মানুষের বসবাস অসম্ভব। এই যে সামাজিকতা তার সূত্রপাত প্রথমত পরিবারে। কালক্রমে ব্যক্তি বৃহত্তর সামাজিক জীবনে প্রবিষ্ট হয়। নানা সংস্থা ও সংগঠনের সাথে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে যুক্ত হয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এসব সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে বিকশিত হতে থাকে এবং সাংস্কৃতিক পূর্ণতা পায়। ফলে গোষ্ঠী হলো একই উদ্দেশ্য সাধনে একটি সংগঠন। সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা সমগ্র মানবজীবন জুড়ে। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত সামাজিক গোষ্ঠী হলো মানুষের বিচিত্রমুখী সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের আধারস্বরূপ। সেক্ষেত্রে সমাজ ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলো অভিন্ন নয় ।
সামাজিক গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of social group): গোষ্ঠী জীবনের কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক। তাহলে সামাজিক গোষ্ঠী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। বস্তুত সামাজিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্তমান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো নিরূপ :
১. ব্যক্তির সমষ্টি (Collection of individuals) : সামাজিক গোষ্ঠী জনগণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। কোন ব্যক্তি ছাড়া গোষ্ঠী হতে পারে না। যেমনটি ছাত্র ও শিক্ষক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ গড়ে উঠতে পারে না।
২. সদস্যদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া (Interaction among members) : সামাজিক মিথস্ক্রিয়া গোষ্ঠী জীবনের বড় ভিত্তি। ফলে সদস্যদের মধ্যে অবশ্যই সম্পর্ক গড়ে উঠতে হবে। বস্তুত সামাজিক গোষ্ঠী হলো সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া ।
৩. পারস্পরিক সচেতনতা (Mutual awareness) : গোষ্ঠী জীবন পারস্পরিক সচেতনতার উপর নির্ভরশীল। গোষ্ঠীর সদস্যরা একে অপরের সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের আচরণ পারস্পরিক স্বীকৃতি দ্বারা নির্ধারিত থাকে। গিডিংস ‘Consciousness of kind’ জাতীয় সচেতনতার কথা বলেছেন।
৪. ‘আমরা বোধ’ বা (‘We feeling’) : গোষ্ঠীর মধ্যে অবশ্যই গোষ্ঠীগত ঐক্য থাকতে হবে। গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করার প্রবণতা হলো ‘আমরা বোধ’ । এ ভ্রাতৃত্ববোধ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সহানুভূতি তৈরি করে ।
৫. গোষ্ঠীগত ঐক্য ও সংহতি (Group unity and solidarity) : গোষ্ঠীর সদস্যরা ঐক্য ও সংহতি দ্বারা একে অপরের সাথে বাধা। এ ঐক্য ও সংহতি বিপুলভাবে নির্ভর করে সদস্যদের সাবলীলতা, বৈচিত্র্যতা ও আবেগের মাত্রার উপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি পরিবারের মধ্যে বা বন্ধুদের মধ্যে বা একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বা ঐক্য
দৃঢ় কারণ তাদের পৃথক পৃথক স্বার্থ বা উদ্দেশ্য বিদ্যমান ।
৬. সাধারণ সন্তুষ্টি (Group interests) : সন্তুষ্টিই হলো গোষ্ঠীর আদর্শ যা সাধারণ । গোষ্ঠীগুলো বেশিরভাগই গড়ে উঠে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। বস্তুত ব্যক্তি গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয় না বরং গোষ্ঠী গঠন করে তাদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য।
৭. গোষ্ঠীগত শৃঙ্খলা (Group norms) : প্রত্যেক গোষ্ঠীরই নিজস্ব নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা থাকে, যা পালন করা আবশ্যকীয়। এসব আদর্শ নির্মিত হয় মূলত প্রথা, ঐতিহ্য, নৈতিকতা ও প্রচলিত ধারণা ইত্যাদির দ্বারা। প্রত্যেক গোষ্ঠীরই কিছু নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, যার মাধ্যমে সদস্যদেরকে শাস্তি প্রদান বা পুরস্কৃত করা হয় ।
৮. সাদৃশ্যপূর্ণ আচরণ (Similar behaviour) : সাধারণ উদ্দেশ্য হাসিল করতে গোষ্ঠীর সদস্যদের আচরণ কমবেশি একই রকম হতে হবে। সামাজিক গোষ্ঠী সমষ্টিগত আচরণ প্রকাশ করে।
৯. ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব (Influence on personality) : সামাজিক গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সদস্যদের ব্যক্তিত্বের উপর একটা ছাপ ফেলে। সদস্যরা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য সুযোগ তৈরি করে।
১০. সামাজিক গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ (Classification of group social) : সামাজিক গোষ্ঠী শুধু অসংখ্য নয় বরং বৈচিত্র্যময়। ফলে সব গোষ্ঠীকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। গোষ্ঠীগুলোর একটি প্রক্রিয়ায় পাঠ বিজ্ঞানভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ নির্দেশ করে । কিন্তু গোষ্ঠীগুলো জটিল ধরনের কারণে তাও প্রায় অসম্ভব। সমাজবিজ্ঞানিগণ গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ করে সফল হতে পারেন নি। কিছু কিছু চিন্তাবিদ গোষ্ঠীর সহজ শ্রেণিবিভাগ করেছেন আবার অন্যেরা ব্যাখ্যামূলক শ্রেণিবিভাগ দিয়েছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত অলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো সমাজজীবনে বুনিয়াদস্বরূপ। গোষ্ঠী জীবনে আমরা কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি, যেগুলোর মাধ্যমে মানুষের গোষ্ঠী জীবন হয়ে উঠে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ । সুতরাং বলা যায় যে, সমাজজীবনে গোষ্ঠী জীবনের ভূমিকা অপরিহার্য।