সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়ােগের ধাপসমূহ আলােচনা কর ।

প্রশ্ন ১৩৷ সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ধাপসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের স্তরসমূহ বিশ্লেষণ কর।


উত্তরা৷ ভূমিকা : প্রতিটি বিজ্ঞানেই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে তার কার্যক্রমের কয়েকটি ধাপ বা পর্যায় রয়েছে। এই পর্যায়গুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পরিচায়ক। সমাজ বা সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীগণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করেন। একজন প্রকৃত সমাজ গবেষক হিসেবে গবেষককে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কাজগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। যেমন- সমস)। নির্বাচন বা চিহ্নিতকরণ, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যসংগ্রহ, তথ্যের শ্রেণিবিন্যাস, কল্পনা বা পূর্বানুমান প্রণয়ন, সত্যতা বা যথার্থতা যাচাই ও ভবিষ্যদ্বাণী ।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের ধাপসমূহ : নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :


১. সমস্যা নির্বাচন ও চিহ্নিতকরণ : গবেষণার প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন হয় একটি সামাজিক সমস্যাকে নির্বাচন করা। সামাজিক সমস্যা নির্বাচনের জন্য গবেষককে অবশ্যই লক্ষ এতে হবে, যে সমস্যা নির্বাচন করা হলো তা সামাজিক সমস্যার অন্তর্ভুক্ত কি না । সকল সামাজিক ঘটনাই সমাজবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত নয় । যেসব সমস্যা সামাজিকভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে, এমন সমস্যা নির্বাচন করতে হবে। সমস্যা নির্বাচন করে তাকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরণ বা স্পষ্টভাবে বিশেষ ক্ষেত্র উল্লেখ ও নামকরণ করে একটি শিরোনাম দিতে হবে । যেমন— শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে যাচ্ছে, কুমার সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক জীবনধারা : একটি সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, মাদকাসক্তি, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি ।

২. পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ : সমস্যা নির্বাচনের পরে গবেষকের দায়িত্ব হচ্ছে সমস্যাকে অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা । এ পর্যায়ে সামগ্রিক গবেষণা (Macro-research) করতে হলে গবেষক একাধিক তথ্য সংগ্রহকারী পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। সমসাময়িক কালে প্রচলিত তথ্য সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে পর্যবেক্ষণ কাজ করে। যেমন- ওয়েবস্ (Webbs) এর মতে, “All social research begins and ends with observation.” অর্থাৎ সকল গবেষণার প্রারম্ভ এবং সমাপ্তি পর্যবেক্ষণে নিহিত।


পর্যবেক্ষণ সামাজিক গবেষণাকে নিম্নলিখিতভাবে সাহায্য করে থাকে :
ক. পর্যবেক্ষণ কোনো একটি বিষয় বা ঘটনার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে ও গবেষণার পূর্বানুমান গঠনে সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য পদ্ধতি দ্বারা যাচাই করা যায় । অন্যান্য পদ্ধতির সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণে পর্যবেক্ষণ বিশদভাবে সাহায্য করে ।

গ. ঘটনার বিশদ বিবরণ সম্বলিত গবেষণা ও কার্যকারণ সম্পর্কিত পূর্বানুমান যাচাইয়ের জন্য পর্যবেক্ষণ একটি স্বীকৃত পদ্ধতি । এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, গবেষণা সমস্যার ধরনের উপর নির্ভর করবে কোন পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। সমাজ গবেষকের এ পর্যায়ে তার মনমানসিকতাকে গবেষণার কার্যে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমস্যার তথ্যাবলি সংগ্রহ করতে হবে।

৩. তথ্যের শ্রেণিবিন্যাস : গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যাবলির শ্রেণিবিভক্তিকরণ একান্ত আবশ্যক। কেননা তথ্যাবলির শ্রেণিবিভক্তিকরণ ব্যতীত সামাজিক গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তথ্যাবলির শ্রেণিবিভক্তিকরণের মাধ্যমে সমস্যাকে সঠিকভাবে সমাধান করা সম্ভব হয়।
তথ্য বা উপাত্ত দু’ধরনের হতে পারে; যথা : গুণগত (Qualitative) এবং পরিমাণগত বা সংখ্যাতাত্ত্বিক (Quantitative) । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সমাজবিজ্ঞান এর গবেষণায় বর্ণনামূলক বা গুণগত বেশিরভাগ তথ্য সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সকল তথ্যকে সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বয়স, আয় ইত্যাদি সংখ্যার সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। সমাজবিজ্ঞানে গুণগত তথ্যকে বর্তমান Code এর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সকল তথ্যকে সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
শ্রেণিবিন্যাস পর্যায়ে গবেষককে লক্ষ রাখতে হবে যাতে করে সমস্যার সাথে সম্পর্কিত কোনো তথ্য বাদ না পড়ে এবং সংগৃহীত তথ্য যথাযথভাবে শ্রেণিবদ্ধ হয়। এ পর্যায়ে পরিসংখ্যান এবং কোড বা সংকেত এর ব্যবহার গবেষককে সহায়তা করতে পারে। গবেষণার ফলাফল তথ্য শ্রেণিবদ্ধকরণের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়।

৪. পূর্বানুমান প্রণয়ন : পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের পর্যায়ে যে ফলাফল পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে সমস্যা সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়াই হচ্ছে পূর্বানুমান প্রণয়ন। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, গবেষক যখন কোনো তত্ত্ব যাচাই করার চেষ্টা করেন, তখন তথ্য সংগ্রহের পূর্বেই পূর্বানুমান প্রণয়ন করে থাকে। ‘পূর্বানুমান’ বা ‘কল্পনা’ মূলত অনুমানভিত্তিক এবং সে কারণেই অনেকটা অনিশ্চিত। অবশ্য তত্ত্বকেও সবক্ষেত্রে অকাট্য বা নির্ভুল ও সুনিশ্চিত বলা চলে না, কারণ নতুন আলোকপাতের ফলে তত্ত্বে পরিবর্তন হতে পারে তবে তত্ত্বের নিশ্চয়তার অনুপাত পূর্বানুমান থেকে খানিকটা বেশি ।

৫. সত্যতা যাচাই : এ পর্যায়ে গবেষকের কাজ হচ্ছে গবেষণা এলাকা থেকে যেসব তথ্য সংগৃহীত ও শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফল পূর্বে প্রণীত পূর্বানুমানের সাথে কতটুকু সত্য বা যথার্থ তা পরীক্ষা করা। এ সত্যতা যাচাই এর মাধ্যমে পূর্বানুমান গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। অর্থাৎ অনুমিত কল্পনা বাস্তব ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত বা সঠিক হতে পারে, অথবা এর বিপরীত বা নেতিবাচক হতে পারে। সেজন্য তত্ত্বের সাথে পূর্বানুমানের সংযুক্ত ফলাফল সংগৃহীত তথ্যের সাথে যাচাই করলেই প্রকৃত সত্য বা যথাযথ ফলাফল বের হয়ে আসতে পারে। গবেষক এ পর্যায়ে নতুন তত্ত্বও পেতে পারেন, নতুন তত্ত্ব নির্বাহের সাথে সাধারণীকরণ (Generalization) বিষয়টি সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে বিষয় বা অবস্থার নির্দিষ্ট কোন অংশের পরিবর্তে সার্বিক দিকটিকেই বিমূর্তভাবে তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ বিশেষে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সাধারণের সত্যতা উপস্থাপন করা হয়।


৬. ভবিষ্যদ্বাণী : সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামাজিক বিকাশের সিদ্ধান্তবলি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের ন্যায় ততটা সুনিশ্চিত নয়। সামাজিক গ্রুপঞ্চগুলো প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের ন্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কার্যকারণ সম্পর্ক নিরূপণ, অনুমান (Guess) এবং সিদ্ধান্ত (Inference) গ্রহণ করা সম্ভব নয়। সেজন্য সমাজ গবেষণায় গবেষককে নির্দিষ্ট গবেষণালব্ধ বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়। তবুও গবেষণার আলোকে গবেষককে একটি স্থির সিদ্ধান্ত নিতে হয় । যেমন- অপরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত জনসংখ্যা সমস্যা। গবেষণার ফলাফলে বলা যেতে পারে বা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে যে, যে-কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটতে পারে ।


উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমানে সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সামাজিক সমস্যার কারণ ও এর প্রকৃতি নির্ণয় এবং এ সম্পর্কে নতুন তত্ত্ব বিনির্মাণের প্রয়াস ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ সমাজবিজ্ঞানে যত বেশি বৃদ্ধি পাবে, সমাজবিজ্ঞান ততবেশি বস্তুনিষ্ঠ হবে।