সাংস্কৃতিক নিবর্তন কাকে বলে? পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক নিবর্তনের কারণগুলো কী ছিল?
অথবা, সাংস্কৃতিক নিবর্তন কী? পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক নিবর্তনের কারণগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। পশ্চিমের শাসকগোষ্ঠীরা বাঙালি জাতির হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ভাষার ও সংস্কৃতির উপর প্রথম আঘাত হানে।
সাংস্কৃতিক নির্বতন : দুই অঞ্চলের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। পূর্ব বাংলার অধিবাসীরা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬%। এদের ভাষা বাংলা এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। বাকি ৪৪% জনসংখ্যার মধ্যে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মানুষ ছিল এবং এদের মাত্র ৭.২% লোকের ভাষা ছিল উর্দু। পাকিস্তান সরকার এ সংখ্যাগরিষ্ঠদের বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে এবং বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সাথে সাথে হাজার বছরের পুরনো বাঙালি জাতির সংস্কৃতি মুছে ফেলার মাধ্যমে বাঙালিদের পাকিস্তানিকরণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ প্রক্রিয়া বাঙালির উপর সাংস্কৃতিক নিবর্তন নামে খ্যাত ।
সাংস্কৃতিক নিবর্তনের কারণ : পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষায় রূপদান এবং বর্ণমালা ও সংস্কৃতির সংস্কারের পিছনে সরকারের কতকগুলো ভিত্তিহীন যুক্তি উপস্থাপন করেছিল। যথা :
১. ঐতিহাসিক কারণ : ঐতিহাসিক যুক্তি হিসেবে তারা দেখান যে অতীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা এবং সাহিত্যের পরিবর্তন হয়েছে, যেমন- মধ্যযুগে ইসলামি রূপ এবং ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজি ভাষার প্রবর্তন হয়। ঐতিহ্য অনুসারেই বর্তমানে বাংলা ভাষায় পাকিস্তানি রূপ দেওয়া আবশ্যক।
২. রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য গঠন : ১৯৪৯ সালে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা হিসেবে যুক্তি দেখানো হয় যে, পাকিস্তানের ৯০% মানুষ আরবি ভাষা বুঝে তাই পাকিস্তানের মানুষকে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করার জন্য আরবি হরফের চালু করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
৩. বাংলা ভাষাকে পবিত্রকরণ : ১৯৪৯ সালে বাংলা থেকে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব দূর করে পবিত্র করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং সেই কমিটি বাংলা বর্ণমালায় কিছু বর্ণ বাদ দিয়ে ‘অ্যা’ শব্দ যোগ করার পরামর্শ দেন।
ক. সর্বজনীন সহজ ভাষার প্রবর্তন : ১৯৫২ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রে একটি সহজ ও সর্বজনীন ভাষা সৃষ্টির লক্ষ্যে রোমান হরফে বাংলা ও উর্দু ভাষা লেখার পদক্ষেপ নেন।
খ. বাঙালিরা সংস্কৃতি থেকে হিন্দুর প্রভাব মুক্ত করার পদক্ষেপ : সরকার ১৯৬০ এর দশকে রবীন্দ্রসংগীত এবং বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর কারণ হিসেবে দেখান যে, এগুলো হিন্দু সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত।
গ. বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্তব্ধ করা : সাংস্কৃতিক নিবর্তন এর পিছনে আর একটি হীন ষড়যন্ত্র হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্তব্ধ করা। উর্দু ভাষা চালু করে গোটা বাঙালি জাতিকে মূর্খ করে রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন সুদৃঢ় ও সুদীর্ঘ করা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে স্তব্ধ করার জন্যই পাকিস্তান সরকার ধাপে ধাপে বাঙালি জাতির উপর সাংস্কৃতিক নির্যাতন চালাতে থাকে। পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক নিবর্তনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষ প্রথমে প্রতিবাদ এবং পরে আন্দোলন শুরু করে।