সাংখ্য দর্শন অনুসারে পুরুষ-এক না বহু সংক্ষেপে লিখ ।
অথবা, সাংখ্য দর্শন অনুসারে পুরুষ কী একা না বহু?
অথবা, সাংখ্য দর্শন অনুসারে আত্মা এক না বহু?
উত্তর৷ ভূমিকা : সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনগুলোর মধ্যে প্রাচীন। সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবর্তক হলেন মহর্ষি কপিল । সাংখ্য দর্শনের দুটি অর্থ আছে। যথা : প্রথমত, সম্যক জ্ঞান এবং দ্বিতীয়ত, সংখ্যাবোধক তত্ত্ব। সাংখ্য দর্শন হচ্ছে দ্বৈতবাদী দর্শন। কারণ সাংখ্য দার্শনিকগণের মতে, জগতের আদিকারণ বা আদিসত্তা হিসেবে দুটি সত্তা রয়েছে। যথা :
ক. প্রকৃতি ও খ. পুরুষ। নিম্নে পুরুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
পুরুষ এক, না বহু : সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, পুরুষ বা আত্মা এক নয়, বহু। পুরুষ বা আত্মার বহুত্বের প্রমাণস্বরূপ সাংখ্য দার্শনিকগণ নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেছেন। যথা :
প্রথমত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, পুরুষ বা আত্মা যদি বহু না হয়ে এক হতো তবে একজনের মৃত্যু বা জন্মের সাথে সাথে অন্য একজনের জন্ম বা মৃত্যু হতো। একজনের কোন ইন্দ্রিয় বিকল হলে অপর লোকেরও ইন্দ্রিয় বিকল হতো। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। সুতরাং এ থেকে সিদ্ধান্তে পৌছাতে হয় যে, পুরুষ বা আত্মা এক নয়, বহু ।
দ্বিতীয়ত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, পুরুষ বা আত্মা বহু না হয়ে যদি এক হতো তবে সকল মানুষই একসাথে এক কাজ করত। যেমন : একজন ঘুমালে অপর মানুষও ঘুমাত। কিন্তু আসলে তা হয় না। বাস্তবে একজন ঘুমালে অন্যজনকে আমরা কর্মে ব্যস্ত থাকতে দেখি। সুতরাং পুরুষ এক নয়, বহু।
তৃতীয়ত, সাংখ্য মতে, মানুষ একদিকে যেমন ঈশ্বর নয়, অপরদিকে পশু-পক্ষীও নয়। সকলেরই যদি একই আত্মা হতো তবে ঈশ্বর, মানুষ এবং পশু-পক্ষীর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকত না। এতে প্রমাণ হয় যে, পুরুষ বা আত্মা এক নয়; বরং বহু ।
চতুর্থত, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এ তিন গুণের বিপর্যয় বা ভিন্নতার দ্বারাও আত্মার বহুত্ব প্রমাণিত হয়। যেমন- যে ব্যক্তির মধ্যে সত্ত্বগুণ প্রধান হয় সে সুখী হয়; যার মধ্যে রজোগুণ প্রধান হয় সে দুঃখী হয়। আর যার মধ্যে তমোগুণ প্রধান হয় সে মোহমুক্ত হয়। কাজেই সকল মানুষের মধ্যে যদি একই আত্মা বিরাজ করতো তবে কেউ
সুখী, কেউ দুঃখী এবং কেউ মোহযুক্ত হতো না। সুতরাং আত্মা এক নয়, বরং অবশ্যই বহু।
পঞ্চমত, সাংখ্য মতে, পুরুষ বা আত্মা যদি বহু না হয়ে এক হতো তবে কোন ব্যক্তির মুক্তি লাভের সাথে সাথে অপর ব্যক্তিরাও মুক্তি লাভ করতো। কিন্তু তা যখন হয় না, তখন পুরুষ বা আত্মার বহুত্ব স্বীকার করতেই হয়।
এভাবে উপর্যুক্ত যুক্তির মাধ্যমে সাংখ্য দার্শনিকগণ বহু পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি, জগৎ সৃষ্টির উপাদান-কারণ হিসেবে সাংখ্য দার্শনিকগণ যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তা ভারতীয় দর্শনে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং জগৎ সৃষ্টির জন্য পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন বলে যে বক্তব্য প্রদান করেছে তার গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। কাজেই পুরুষ বা আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে সাংখ্য দার্শনিকগণ যে
যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন তা ভারতীয় দর্শনে বিশেষ একস্থান দখল করে আছে।