সাংখ্য দর্শনের কার্যকারণ মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদ ব্যাখ্যা কর। পরবর্তী ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কীভাবে তা সমালোচনা করে, তা আলোচনা কর।
অথবা, সাংখ্য দর্শনে সৎকার্যবাদ আলোচনা কর। ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কীভাবে সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদ সমালোচনা করেন?
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংখ্য দর্শনই প্রাচীন। সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক এবং প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কপিল। সাংখ্য দর্শনের আদি গ্রন্থ হলো কপিল প্রণীত ‘তত্ত্ব সমাস’। কপিল মুনির পরে তাঁর শিষ্য আসুরি এবং আসুরির শিষ্য পঞ্চশিখ সাংখ্য দর্শনের বিস্তারিত আলোচনা করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে যে সমস্ত গ্রন্থ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা’ সর্বপ্রাচীন এবং প্রমাণিত। নিম্নে প্রশ্নের আলোকে সাংখ্য কার্যকারণ মতবাদ বা সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদ আলোচনা করা হলো।
সাংখ্য দর্শনের কার্যকারণবাদ : সাংখ্য দর্শনের কার্যকারণবাদকে সৎকার্যবাদ বলা হয়। এ সৎকার্যবাদই সাংখ্য দর্শনের প্রধান ভিত্তি। সাংখ্য দর্শনের মধ্যে কারণ ব্যতীত কোন কার্য ঘটে না। সাংখ্য দর্শন মতে, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে তা উপাদান কারণের মধ্যে অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। যেমন, তিল হতে যখন তৈল উৎপন্ন হয়, তখন তৈলরূপ কার্যের উপাদান কারণ হয় তিল। সাংখ্য মতে, তিলের মধ্যে তৈল অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। তিল পিষ্ট হলে তৈলের উৎপত্তি হয়। সুতরাং সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, সৎ হতে সৎ এর উৎপত্তি। অসৎ হতে সৎ এর উৎপত্তি কখনো সম্ভব নয়।
সাংখ্য দর্শনের এ সৎকার্যবাদকে বিভিন্ন সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। বৌদ্ধ ও ন্যায় বৈশেষিক দার্শনিকগণ সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকগণ বৌদ্ধ ও ন্যায় বৈশেষিক মতবাদ খণ্ডন করে তাঁদের সৎকার্যবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নোক্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন।
প্রথমত, কার্য যদি উপাদান-কারণে বিদ্যমান না থাকে, তবে কারো পক্ষে কারণ হতে কার্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। যেমন— শিল্পী শত চেষ্টা করলেও কালো রঙকে সাদা রঙ করতে পারে না। কার্য যদি উপাদান-কারণে বিদ্যমান থাকে, তবে কার্য উৎপন্ন হয়। এ কথা বলা হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেছেন, কার্য উপাদান-কারণে অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে এবং কার্যের এ অব্যক্ত বা প্রচ্ছন্ন অবস্থা হতে ব্যক্ত বা প্রকট হওয়াকেই উৎপন্ন হওয়া বলা হয়, যেমন,
তিলের মধ্যে তৈল অব্যক্ত থাকে এবং তিল যখন পিষ্ট হয়, তখন তৈল ব্যক্ত হয়। এ ব্যক্ত হওয়ার নামই উৎপন্ন হওয়া।
দ্বিতীয়ত, উপাদান-কারণের সাথে কার্যের একটি অপরিহার্য সম্পর্ক আছে। যে কোন উপাদান কারণ কেবল সেই বজ্রকে উৎপন্ন করতে পারে যার সাথে উক্ত উপাদানের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- ছানা কেবল দুধ হতে উৎপন্ন হয়, কারণ দুধ এবং ছানার মধ্যে অপরিহার্য সম্বন্ধ রয়েছে। ছানা কিন্তু জল হতে উৎপন্ন হয় না। কেননা ছানা এবং জলের মধ্যে অপরিহার্য সম্বন্ধ নেই।
তৃতীয়ত, সব সময় দেখা যায়, একটি বিশেষ উপাদান-কারণ হতে একটি বিশেষ কার্য উৎপন্ন হয়। যেমন- তিল হতে তৈল, মৃত্তিকা হতে ঘট, দুধ হতে দধি ইত্যাদি। এতে মনে হয়, কার্য যে কোনভাবে কারণের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। তা না হলে যে কোন কার্য, যে কোন কারণ হতে উৎপন্ন হতো। কিন্তু আসলে তা হয় না।
চতুর্থত, যে কারণের মধ্যে যে কার্য উৎপাদন করার শক্তি থাকে, সে কারণ কেবল সেই কার্যকেই উৎপন্ন করতে পারে; অন্য কোন কার্যকে নয়। যেমন- মৃত্তিকার মধ্যে ঘট উৎপাদন করার শক্তি আছে বলে মৃত্তিকা ঘট উৎপন্ন করে, কিন্তু মৃত্তিকা হতে টেবিলের উৎপত্তি হতে পারে না। এটা হতে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, কার্যকারণের মধ্যে অব্যক্ত থাকে।
পঞ্চমত, কার্য যদি সত্যই উপ
াদান-কারণের মধ্যে বিদ্যমান না থাকে, তবে কার্য উৎপন্ন হলে বলতে হয় ‘অসৎ’ হতে ‘সৎ’ এর উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ কিছু না থাকা হতে কিছুর উৎপত্তি হয়েছে, যা অসম্ভব এবং উদ্ভট। সুতরাং কার্যকারণের মধ্যে যে সম্পর্ক বিদ্যমান তাকে এককথায় স্বীকার করতে হয়।
ষষ্ঠত, কোন কার্য এবং তার কারণ ভিন্ন নয়। কার্য তার উপাদান-কারণের অবস্থান্তর মাত্র। যেমন- কাপড় এবং তার সুতা ভিন্ন নয়, একই দ্রব্যের ব্যক্ত এবং অব্যক্ত অবস্থা। কাপড় সুতার ব্যক্ত অবস্থা; আর সুতা কাপড়ের অব্যক্ত অবস্থা। পূর্বোক্ত যুক্তিগুলোর কথা চিন্তা করে সাংখ্য দার্শনিকগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কোন কার্য উৎপন্ন
হওয়ার পূর্বে তা উপাদান-কারণের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। অর্থাৎ তাঁরা সৎকার্যবাদই স্বীকার করেছেন। সৎকার্যবাদ আবার দুই রকমের হতে পারে। যথা : পরিণামবাদ এবং বিবর্তনবাদ। পরিণামবাদ অনুসারে কোন কারণ হতে যখন কোন কার্য উৎপন্ন হয়, তখন কারণটি কার্যে উৎপন্ন হয়; যেমন- কোন দুধ হতে যখন দধি উৎপন্ন হয়, তখন ঐ দধি ঐ দুধেরই পরিণাম। সাংখ্য দার্শনিকরাই এ পরিণামবাদেরই সমর্থক। আর বিবর্তনবাদ অনুসারে কারণ প্রকৃতপক্ষে কার্যে পরিণত হয় না, এটা প্রতিভাত হয় মাত্র। অর্থাৎ কার্যকারণের যথার্থ পরিণাম নয়। যেমন- রজ্জুকে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জু সর্পে পরিণত হয় না, সর্পের মতো প্রতিভাত হয় মাত্র। সাংখ্য দর্শন এ বিবর্তনবাদ স্বীকার করে না। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত এ বিবর্তনবাদের সমর্থক।
সমালোচনা : বৌদ্ধ দার্শনিকরা সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদের বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, কার্যটি কারণের মধ্যে সুপ্ত থাকে না। বৌদ্ধ দর্শন মতে, কার্যটি কারণের মধ্যে অসৎ, কাজেই কার্যকারণ হতে নতুনভাবে সৃষ্ট হয়। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, অসৎ বা অভাব হতে সৎ বা ভাব পদার্থের উৎপত্তি হয়। তাঁরা বলেছেন, বীজ হতে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, এ
কথা না বলে বীজের অভাব হতেই অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, এ কথা বলা সমীচীন। ন্যায় বৈশেষিকগণও সাংখ্যের সৎকার্যবাদের বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেছেন, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে তা উপাদান-কারণে বিদ্যমান থাকে না। তাঁদের মতে, উপাদান-কারণ হলো সৎ, আর কার্য হলো অসৎ। ন্যায় বৈশেষিকদের মতে, ‘সৎ’ হতে ‘অসৎ’ এর উৎপত্তি বা আরম্ভ। তাই এ মতবাদকে অসৎকার্যবাদ বা আরম্ভবাদ বলা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাংখ্য দর্শনে সৎকার্যবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদকে বৌদ্ধ ও ন্যায় বৈশেষিক দর্শন সমালোচনা করলেও তাদের সৎকার্যবাদ বা কার্যকারণ মতবাদ পরবর্তী
দার্শনিক সম্প্রদায়ের কার্যকারণবাদকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাইতো সাংখ্য সৎকার্যবাদ বা কার্যকারণ মতবাদ ভারতীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ।