সমালোচনাসহ চার্বাক জড়বাদ আলোচনা কর।
অথবা, সমালোচনাসংজগৎ সম্পর্কে চার্বাকদের মতামত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমালোচনাসহ সর্বাক বস্তুবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জড়বাদ সম্পর্কে চার্বাকদের অভিমত ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভোগবাদী ও জড়বাদী দর্শন। আর জড়বাদী দর্শন বলতে ভারতীয় দর্শনে কেবল চার্বাক দর্শনকেই বুঝায়। কারণ চার্বাকরাই জড়কে জগতের একমাত্র আদিসত্তা মনে করেন এবং উল্লেখ করেন যে, জড় থেকেই জগতের সবকিছুর উদ্ভব। এমনকি প্রাণ এবং মনও জড় থেকে
উৎপত্তি। চার্বাকগণ জড়বাদী ও ভোগবাদী ছিলেন বলে ভোগবিলাসকেই জীবনের সুখের একমাত্র নীতি বলে গ্রহণ করেন। ‘প্রয়োজনে ঋণ করে হলেও ঘি খাও’ চার্বাকরা এ নীতিতে বিশ্বাসী।
চার্বাক জড়বাদ : ভারতীয় দর্শনে চার্বাক জড়বাদীরা উল্লেখ করেন যে, জড়বস্তুই জগতের আদিসত্তা। জড় থেকেই জগৎ তথা এর অন্তর্নিহিত সবকিছুর উদ্ভব। কারণ জড়ই একমাত্র প্রত্যক্ষগোচর। জড় ভিন্ন অন্য কোন বস্তু প্রত্যক্ষগোচর নয়। চার্বাকরা জড়ের উপর ভিত্তি করেই তাদের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন যুক্তির আলোকে
জড়বাদকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন। যা নিম্নে প্রদত্ত হলো :
১. জড়বাদী ব্যাখ্যায় চার্বাক দার্শনিকরা মাটি, পানি, আগুন এবং বায়ুকেই মৌলিক পদার্থ বলে স্বীকার করে নেন। তাঁদের মতে, এ চারটি পদার্থই বাস্তব ও প্রত্যক্ষগোচর। এ চারটি মৌলিক পদার্থই সূক্ষ্মতর বস্তুতে অবিভাজ্য. এবং পরস্পরের সংমিশ্রণের ফলে যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টি হয়।
২. চার্বাকদের মতে, প্রত্যক্ষিত বস্তুই অস্তিত্বশীল। আকাশকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, তাই আকাশ পদার্থ বলে স্বীকৃত নয়। ন্যায় বৈশেষিকরা আকাশকে একটি ভাব পদার্থ বলে স্বীকার করে নিলেও চার্বাকরা বলেছেন যে, অনুমান সাপেক্ষ কোন দ্রব্যকে নিত্য বলে স্বীকার করা যায় না। জড়বস্তুই একমাত্র প্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং প্রমাণ সাপেক্ষ। এজন্য জড়বস্তু মাত্রই অস্তিত্বশীল। চার্বাক জড়বাদী দর্শনে কার্যকারণের সম্বন্ধকে অস্বীকার করা হয়। তাঁদের মতে, আমরা দুটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করি মাত্র। কিন্তু নির্দিষ্ট দুটি বস্তু বা দুটি ঘটনা যে কার্যকারণ নামে একটি নিরবচ্ছিন্ন এবং সার্বিক সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আছে এবং থাকবে তা আমরা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে স্থির করতে পারি না। এজন্য চার্বাকদের মতে, কার্যকারণ মানে দুটি ঘটনা নিতান্তই যুগপৎ এবং আকস্মিকভাবে ঘটে থাকে।
- চার্বাক জড়বাদে দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। চার্বাকদের মতে, চেতনা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বলে চেতনার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এর আধাররূপে আত্মার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। চেতনা দেহের ধর্ম, কোন
অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য আত্মারূপ অতীন্দ্রিয় সত্তার ধর্ম বা গুণ নয়। ক্ষিতি বা মাটি, অপ বা জল, তেজ বা আগুন এবং মরুৎ বা বায়ু এ চারটি উপাদানের সংমিশ্রণে যখন জীবদেহ গঠিত হয় তখন সে জীবদেহে চেতনারূপ একটি
নতুন ধরনের আবির্ভাব ঘটে। চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। দেহাতিরিক্ত কোন অতীন্দ্রিয় আত্মার অস্তিত্ব নেই।
৫. চতুর্ভূতের সমন্বয়ে যে দেহ গঠিত হয়, তাতে চৈতন্যের আবির্ভাব হয় কিভাবে? এ প্রশ্ন করা হলে চার্বাকরা তাঁদের জড়বাদী ব্যাখ্যা উল্লেখ করেন। তারা দৃষ্টান্ত দিয়ে উল্লেখ করেন পান, সুপারি ও চুন এদের কোনটির মধ্যে কোন লাল আভা নেই, কিন্তু চর্বণ করলে লাল আভা দেখা যায়। আবার যেসব বস্তু দ্বারা সুরা উৎপন্ন হয়
তাদের কোনটির মধ্যেই মাদকতা শক্তি থাকে না, কিন্তু সংমিশ্রণের ফলে মাদকতা শক্তির উদ্ভব হয়।
৬. চার্বাক জড়বাদে বলা হয়, মৃত্যুতেই জীবের পরিসমাপ্তি। জন্মান্তর, পরলোক, স্বর্গ, নরক প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ মাত্র। এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো কল্পনার বিষয়। প্রতারক ও ধূর্ত ব্যক্তিরা বেদের সৃষ্টি করে। স্বর্গ, নরক প্রভৃতি নানাপ্রকার অলৌকিক কথা বলে মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে।
৭. চার্বাকদের মতে, জগৎ সৃষ্টির পিছনে কোন উদ্দেশ্য বা পরিণতি নেই। স্বাভাবিক জাগতিক নিয়ম অনুসারে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। স্বভাবের কারণেই জগতে সবকিছুর উৎপত্তি। এজন্য এর মতবাদকে চার্বাক দর্শনে স্বভাববাদ বলা হয়।
৮. চার্বাক দার্শনিকেরা ধর্মের মূলে কঠিন কুঠারাঘাত হানেন। তাঁদের মতে, ধর্ম হলো অলীক কল্পনা, স্বপ্নমাত্র এবং সুবিধাবাদী লোকদের রুটি, রুজি ও ভাত জুটাবার একমাত্র কলাকৌশল
৯. চার্বাক জড়বাদে জড়ের বাইরে কোন অসীম সত্তাকে বিশ্বাস করা হয় না এবং বলা হয় আধ্যাত্মিক শক্তি বলে কোন অসীম সত্তা নেই। আধ্যাত্মিক সত্তা অলৌকিকতারই নামমাত্র।
১০. চার্বাকরা তাদের জড়বাদী দর্শনে কেবলমাত্র প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করে বলে একে প্রকৃতবাদও বলা হয়।
১১. চার্বাক জড়বাদে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। কারণ ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয় নয় এবং অনুমান দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করা যায় না। অনুমান অসিদ্ধ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের যদি প্রকৃত অস্তিত্ব থাকতো তাহলে ঈশ্বর নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে মানুষের মনের সকল সংশয় দূর করতেন। তাই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে কোন জগৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান করা নিষ্প্রয়োজন।
সমালোচনা : বিভিন্নভাবে চার্বাকরা জড়বাদকে স্বীকার করে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করলেও তা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে আপত্তি বা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. চার্বাকরা জড়বাদে প্রত্যক্ষণকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষণই একমাত্র বড় প্রমাণ নয়। তার চেয়ে বড় প্রমাণ হলো প্রত্যক্ষণই যে একমাত্র প্রমাণ তা প্রত্যক্ষ করা যায় না। একথা চার্বাকরা তাদের দর্শনে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২. চার্বাকরা মনে করেন যে, জড় হতেই চৈতন্যের উৎপত্তি। কিন্তু জড় ও চৈতন্য সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। জড় হলো চেতনাহীন । কিন্তু কি করে চেতনাহীন হতে চৈতন্য উৎপত্তি সম্ভব তা বোধগম্য নয়।
৩. চার্বাক জড়বাদ মনে করেন যে, প্রাণশক্তিও জড়শক্তি থেকে উদ্ভূত। কিন্তু প্রাণশক্তি ও জড়শক্তি প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন। কারণ জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো জড়শক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।
৪.চার্বাক দর্শনে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকেই সুনিশ্চিত জ্ঞানের আঁধার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু একথা ঠিক নয়। কারণ ইন্দ্রিয় মানুষের সাথে প্রতারণা করে। ইন্দ্রিয়ের কারণে মানুষ দড়িকে সর্প মনে করে। কাজেই চার্বাকদের মতে, ইন্দ্রিয় জ্ঞান সঠিক নয়। চার্বাকরা জড়বাদী ব্যাখ্যায় কার্যকারণকে অস্বীকার করেন। কিন্তু আধুনিক যুগে চার্বাকদের এ কথাকে স্বীকার
করে নেয়া যায় না। কারণ প্রত্যেক ঘটনারই কারণ আছে। কারণ ছাড়া কোন ঘটনা ঘটতে পারে না এবং কারণ ও কার্যের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক বিদ্যমান।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের মতে, অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা। জড়বাদী হওয়ার কারণেই দর্শন আত্মা বা ইশ্বরে বিশ্বাস করে না। জাগতিক সুখ ভোগকে সাধারণ মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করে। সাধারণ লোকের চিন্তা ও ভাবধারাকে এ দর্শন ব্যক্ত করে বলে একে লোকায়ত দর্শন বলে। এ দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য দর্শনের কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও চার্বাকদের জড়বাদী ধারণা স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে।