সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজের বিজ্ঞান”- (ওয়ার্ড ও সামনার) এ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, “সমাজবিজ্ঞানী ওয়ার্ড ও সামনাব এর “সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজের বিজ্ঞান” উক্তিটির সত্যতা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞান কী একটি বিজ্ঞান-ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একা বাস করতে পারে না। সমাজেই মানুষের জন্ম, সমাজই তার লালনপালন করে। এজন্য মানুষ দলবদ্ধভাবে সমাজে বসবাস করে। আর এ সমাজকে নিয়েই আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞান। তাই বলা হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞা নমানুষের সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানে মানুষের দলগত আচরণ ও পারস্পরিক কার্যকলাপ সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে পাঠ করা হয়। কিভাবে মানুষের সমাজে নানাবিধ সংঘের বিকাশ ঘটেছে এবং কিভাবে সমাজের ভিতর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এসবই সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।
সমাজবিজ্ঞান : যে শাস্ত্র সমাজের মানুষের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আচার আচরণ, রীতিনীতি, ধ্যানধারণা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে তাকেই সমাজবিজ্ঞান বলে। অন্যভাবে বলা যায়, বিজ্ঞানের যে শাখায় সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণা করা হয় তাকে সমাজবিজ্ঞান বলে । প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ওয়ার্ড ও সামনার সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বলেছেন, Sociology is the science of society.” অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজের বিজ্ঞান। এ সংজ্ঞাটি আকৃতির দিক থেকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও অর্থগত দিক থেকে এটি অত্যন্ত ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ। ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তিটি বিশ্লেষণ করলে এতে দুটি প্রত্যয় পাওয়া যায়। | এগুলো হলো Science এবং Society. নিম্নে প্রত্যয় দুটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো :
১. বিজ্ঞান (Science) : সহজ কথায় বলা যায়, কোন বিষয় সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান। পরীক্ষা নিরীক্ষা, প্রমাণ, যুক্তি ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত সুশৃঙ্খল জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান। অনেকে বলেছেন, সুসংবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান। পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের যাচাইয়ের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয়। The Oxford Dictionary তে বিজ্ঞানের
সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “গবেষণালব্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান।” অতএব, বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় আমরা বলতে পারি, যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণ ভিত্তিতে অর্জিত সুসংহত জ্ঞানই বিজ্ঞান।
২. সমাজ (Society) : সহজ কথায় বলা যায়, সমাজ হলো একদল লোকের সমষ্টি, যারা একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে এবং যাদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘Society’ গ্রন্থে বলেছেন, “আমরা যেসব সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনধারণ করি তাদের সংগঠিত রূপই হলো সমাজ।”
ওয়ার্ড ও সামনারের উক্তির যথার্থতা ও তাৎপর্য : সমাজবিজ্ঞানী ওয়ার্ড ও সামনার সমাজবিজ্ঞানকে ‘সমাজের বিজ্ঞান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের এ উক্তির আলোকে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান হলো এমন একটি বিজ্ঞান, যা সামাজিক জীবন বা সমাজের কার্যাবলির সমষ্টিকে যুক্তিনির্ভর পদ্ধতি অনুসরণ করে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে থাকে।
মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা : সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত। এটি সর্বদা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে। কেননা সমাজবিজ্ঞান যদি তার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে নিরপেক্ষতা বজায় না রাখত, তাহলে তা বিজ্ঞানের মর্যাদায় উন্নীত হতে পারতো না। এটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানভিত্তিক
আলোচনা করে । তাই বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী সামনার এবং ওয়ার্ড একে ‘সমাজের বিজ্ঞান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিষয়বস্তু : সমাজবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় শুধু সমাজের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে না। এটি সমাজের সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে থাকে। এজন্য অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের
বিষয়বস্তু সমাজের একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট অংশ হলেও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ সমাজকেই নির্দেশ করে। সমাজবিজ্ঞান সমাজের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গঠন, প্রকৃতি ও পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে থাকে। আর এ কারণে সমাজবিজ্ঞানকে সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়ন বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ওয়ার্ড ও সামনার অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে সমাজবিজ্ঞানের একটি সরল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। প্রথমদিকে অনেকে এটাকে ‘দায়সারা’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু কোন সমাজবিজ্ঞানীই আজ পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞানের কোন সর্বজনীন সংজ্ঞা দিতে পারেন নি। একমাত্র ওয়ার্ড ও সামনারই সমাজবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত সকল সংজ্ঞার একটি সারমর্ম তুলে ধরেন। ফলে ছোট হলেও তাঁদের এ সংজ্ঞাটি বলা যায়, “Sociology is the scientific study of society.” অর্থাৎ, সমাজের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়নই হলো সমাজবিজ্ঞান ।