সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন”- স্মল (Small) আলোচনা কর।
অথবা, “সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন”- ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানী Small (স্মল) এর সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক
অধ্যয়ন”—উক্তিটির ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, স্মলের দৃষ্টিতে “সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন”—উক্তিটি কী যৌক্তিক মনে কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক বিজ্ঞানে সামাজিক প্রক্রিয়া পদটি বহুলভাবে ব্যবহৃত। একদিকে, প্রক্রিয়া দ্বারা যেমন সাধারণভাবে মিথস্ক্রিয়ার যে কোন প্রকাশকে বুঝানো হয়ে থাকে; অন্যদিকে, এর দ্বারা সামাজিক কার্যাবলির অব্যাহত রূপকে বুঝানো হয়ে থাকে। তাছাড়া একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থা থেকে অপর সামাজিক অবস্থার স্থানান্তর বুঝাতেও এটি
ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন : সমাজবিজ্ঞানী স্মল এর মতে (Small), “সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন।” একাধিক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠে। তাই সমাজ পাঠে ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ককে জানতে হবে। সামাজিক প্রক্রিয়ার মৌলিক উপাদান হলো এক ধরনের পরিবর্তনশীলতা, গতিময়তা এবং সহিষ্ণুতা। সামাজিক তত্ত্ব বিকাশে সময় বা কালের প্রেক্ষিতে উপলব্ধি করার যে চেতনা, এককথায় তা সামাজিক প্রক্রিয়ারই গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সেদিক থেকে সামাজিক পরিবর্তনে প্রক্রিয়ার তত্ত্বকে স্থিতীয় তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রবল
প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে।
সামাজিক প্রক্রিয়ার প্রকারভেদ : সামাজিক প্রক্রিয়ার প্রকারভেদ নির্ধারণে সমাজতাত্ত্বিকদের ভিতর মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার সামাজিক প্রক্রিয়া এবং তা অধ্যয়নের গুরুত্ব সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. সহযোগিতা (Cooperation) : সহযোগিতা অন্যতম সামাজিক প্রক্রিয়া। সহযোগিতা ছাড়া মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। আর সম্পর্ক ছাড়া সমাজ গঠিত হয় না। সহযোগিতার দুটি প্রধান রূপ নিম্নে দেয়া হলো :
প্রত্যক্ষ সহযোগিতা : প্রত্যক্ষ সহযোগিতা হলো ঐসব কার্যাবলি, যা মানুষ একত্রে করে বা করতে পছন্দ করে। যেমন- একত্রে প্রার্থনা করা।
পরোক্ষ সহযোগিতা : পরোক্ষ সহযোগিতা হলো একই লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন কার্যসম্পাদন করা। এখানেই বিখ্যাত শ্রমবিভাগ নীতিটি কার্যে প্রয়োগ করা যায়।
২. প্রতিযোগিতা (Competition) : প্রতিযোগিতা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রক্রিয়া। প্রতিযোগিতা হলো সামাজিক সংযোগবিহীন পারস্পরিক ক্রিয়া। এটি একদিকে, যেমন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সংগ্রামকে বুঝায়; অন্যদিকে, এটা নৈর্ব্যক্তিকও বটে। প্রতিযোগিতায় সর্বজনীন ও নিরবচ্ছিন্ন মানুষের অজ্ঞাতসারে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সুস্থ প্রতিযোগিতার বিকাশ হয়। প্রতিযোগিতা হলো দৈহিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণের উপায়, যা লিখিত বা অলিখিত সামাজিক নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এটি মানবসমাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গতিশীল থাকে।
৩. দ্বন্দ্ব (Conflict) : সংঘাত বা দ্বন্দ্ব হলো ব্যষ্টিক বা সমষ্টির অভ্যন্তরীণ বিরোধের আরেকটি রূপ । প্রতিযোগিতার সাথেও এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত পরস্পরবিরোধী দুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভিতর এটা সংঘটিত হয়। এটি প্রতিযোগিতার মতো নিরবচ্ছিন্ন ও অবিরামনয়। সংঘাতের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তির সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিরূপিত হয়। সাধারণত সংঘাত ব্যক্তিগত এবং হিংসাত্মক। কিন্তু কোন কোন সংঘাত নৈর্ব্যক্তিক। Small বলেছেন, “কোন সমাজই সম্পূর্ণ সংঘাতমুক্ত ও শান্তিপ্রিয় নয়। কারণ এ ধরনের সমাজে মানুষের প্রাণের স্পন্দন এবং স্থায়ী সামাজিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া যায় না। বস্তুত সমাজের গঠন ও বিকাশের পক্ষে সংহতি ও অসংহতি উভয়ই প্রয়োজন।” তাছাড়া দ্বন্দ্ব সবসময়ই
ধ্বংসা
ত্মক নয়, গঠনমূলকও বটে ।
৪. আত্মীকরণ (Assimilation) : আত্মীকরণ পদটি দ্বারা এমন একটি সামাজিক প্রক্রিয়াকে বুঝানো হয়েছে, যেখানে বহিরাগত একটি সংখ্যালঘু বর্ণগোষ্ঠী বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে দীর্ঘদিন বসবাস ও উত্তরোত্তর গ্রহণের ঐ বৃহত্তর সংস্কৃতির মধ্যে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হয়ে যায়। এক সময় ধারণা করা হতো যে, এ প্রক্রিয়ায় কেবল বহিরাগত বর্ণগোষ্ঠীর
মধ্যেই পরিবর্তন সূচিত হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সমাজে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত বিরাজ করে। সামাজিক প্রক্রিয়া
হিসেবে প্রায়ই আত্মীকরণের পূর্বে সংস্কৃতিকরণ সংঘটিত হয়ে থাকে। অন্যকথায়, সংস্কৃতিকরণ হলো আত্মীকরণের প্রথম পদক্ষেপ । প্রাথমিক সংযোগসমূহের মধ্যে দ্রুত ও স্বাভাবিকভাবে আত্মীকরণ সংঘটিত হয়ে থাকে।
৫. উপযোজন (Accommodation) : যেসব আচরণ বা কার্যাবলি দ্বারা মানুষ তার পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাওয়ায়, ঐসব আচরণ বা কার্যাবলিকে বুঝানোর জন্য মনস্তত্ত্ববিদ James Mark Baldwin সর্বপ্রথম উপযোজন পদটি ব্যবহার করেন। উপযোজন হলো সামঞ্জস্য বিধান বা খাপখাওয়ানো, যা মানুষ সামাজিক সূত্রে অর্জিত আচরণ কিংবা
নতুন কোন আচরণ গ্রহণ করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ করে থাকে। উপযোজন একমাত্র মানুষের দ্বারাই সম্ভব। মানুষকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপখাইয়ে নিতে হয়। মানুষের সামাজিক সংগঠনের বিকাশ হয়েছে প্রধানত উপযোজনের মাধ্যমে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, আত্মীকরণ উপযোজন এর ভূমিকা অপরিসীম। তবে তুলনামূলকভাবে উপযোজনের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। উপযোজন যে কেবল সংঘাতকে হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, বরং তা সামাজিক রীতিনীতির নিরাপত্তা বিধান করে, যাতে বিরোধীস্বার্থের অধিকারী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গ একত্রে নিজ নিজ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে ।