General Knowledge

সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হার্বার্ট স্পেন্সারের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, সমাজবিজ্ঞানের সারতার ক্ষেত্রে ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সারের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে হার্বার্ট স্পেলারের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩) এর নাম বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর তাত্ত্বিক অবদান সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে। মূলত তিনি সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা অগাস্ট কোঁৎ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হার্বার্ট স্পেন্সার আধুনিক যুগের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কিভাবে সমাজ বর্তমান পর্যায়ে এসেছে সে সম্পর্কে তিনি তত্ত্ব দিয়েছেন।
সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হার্বার্ট স্পেলারের অবদান : Auguste Comte ‘Sociology’ নামে মানব জ্ঞানের যে শাখার নামকরণ করেছিলেন তা স্পেন্সার এর হাতে সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। এ প্রসঙ্গে Spencer এর Synthetic Philosophy এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। Comte এর সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য Spencer কে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সমাজবিজ্ঞানের কঙ্কালের উপর সারসংক্ষেপণ করেছেন, যার ভিত্তিতে সমাজবিজ্ঞান একটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। তাঁর মতে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে অজৈব থেকে জৈবিক এবং তা থেকে অধিজৈবিকে। অর্থাৎ সমাজ একটি সরল অবস্থা থেকে ক্রমে জটিলতার দিকে (From Simple to Complex) এগিয়ে যায়। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্বের নাম জৈবিক সাদৃশ্য (Organic Analogy)। Darwin এর তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সমাজের বিবর্তন সম্পর্কে যে তত্ত্ব দেন তা Theory of Universal Evolution নামে পরিচিত। তিনি তাঁর তত্ত্বে সমাজকে দেখেছেন জীবদেহ (Organism) হিসেবে।
সমাজের বিবর্তন : হার্বার্ট স্পেন্সার ১৮৬২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ First Principle এ সমসাময়িক পদার্থবিদ্যা ও দর্শনের আলোকে বিবর্তনের সাধারণ নিয়মাবলি আলোচনা করেছেন। মূলত তিনি প্রাথমিক চিন্তাবিদদের অন্তর্ভুক্ত। বিবর্তনবাদ প্রত্যয়টি সংজ্ঞায়িত করার পূর্বে তিনি এর নিয়মাবলি ব্যাখ্যা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি তিনটি সূত্র ও চারটি
[সূত্র : ১. শক্তির নিত্যতা, ২. বস্তুর অবিনশ্বরতা, ৩. নিরবচ্ছিন্নতা।]
প্রকল্পের প্রস্তাবনা করেছেন। প্রকল্প বা প্রস্তাবনাসমূহ :
১.শক্তিসমূহের আন্তঃসম্পর্কের নিশ্চয়তা।
২.রূপান্তরের ক্ষেত্রে শক্তির অক্ষুণ্ণতা।
৩.বস্তুসমূহের প্রতিকূলতার পথ দিয়ে অগ্রসর হওয়া।
৪.গতির শৃঙ্খলা।
এসব সূত্র ও প্রকল্পসমূহের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তিনি বিবর্তনবাদের পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রদান করেন। হার্বার্ট স্পেন্সার বস্তু ও সমাজজীবনের যাবতীয় বিষয়াদির বিবর্তন দেখিয়েছেন এভাবে- প্রথমত, সরল অবস্থা হতে জটিল অবস্থায় রূপান্তর। দ্বিতীয়ত, সামরিক ও যুদ্ধভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্প সমাজে রূপান্তর। হার্বার্ট স্পেন্সার এর মতে, “বস্তুজগৎ যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সমাজজীবনও পরিবর্তনশীল। জৈবিক অভিব্যক্তির সাথে সামাজিক অভিব্যক্তির সাদৃশ্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি জীবদেহ ও মানবসমাজ উভয়ের সরল অবস্থা থেকে ক্রমে জটিল অবস্থায় উপনীত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।” এককোষী প্রাণী যেমন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরল অবস্থা থেকে জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে, তেমনি হার্বার্ট স্পেন্সার এর মতানুসারে পরিবর্তন ও প্রগতির হাত ধরে মানবসমাজ বন্যদশা থেকে সভ্য দশায় পৌঁছেছে। মাঝখানে অনেক স্তর পার করেছে, হয়েছে সংস্কৃতির অগ্রগতি, যাকে তিনি Super Organic বলে অভিহিত করেছেন।
আদিম সমাজ যুদ্ধপ্রিয় ও ঝগড়াটে অবস্থা থেকে শান্তিপূর্ণ হয়েছে, ক্রমে শিল্প সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হার্বার্ট স্পেন্সার এর মতে, জীবজগতের পরিবর্তন হয়েছে- From inorganic to organic, then to super organic. সমাজের বিবর্তনকে তিনি প্ রগতি বলেছেন।
সামাজিক কাঠামো : সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে হার্বার্ট স্পেন্সার বলেছেন, “সামাজিক কাঠামো হচ্ছে, সমকালীন মূল্যবোধ ও কাঠামোবিশেষ, যা পরস্পর নির্ভরশীল অংশসমূহের দ্বারা গঠিত।” The Man Versus the State’ গ্রন্থে তিনি বহুমুখিতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবসমাজকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সমাজের উন্নয়নে বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠান যেমন- অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পেশাগত প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন।
ধর্মের উৎপত্তি প্রসঙ্গে হার্বার্ট স্পেলার এর ধারণা : হার্বার্ট স্পেন্সার মত পোষণ করেন যে, পূর্বপুরুষের পূজা থেকে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি নৃবিজ্ঞানী Taylor এর Animism কে পুরোপুরি স্বীকার বা অস্বীকার করেন নি। তিনি এ সম্পর্কে Ancestor worship তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেছেন, “Savage tribes who have nothing worth
calling gods, still practise ancestor worship.” তিনি বলেছেন প্রকৃতি পূজা পূর্বপুরুষ পূজারই নামান্তর। তিনি বলেছেন, আদিম উপজাতিদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে, তাদের পূর্বপুরুষদের মৃত আত্মা কেউ গাছ, পাথর, পাহাড়, পর্বত, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি হয়ে গেছে। এ ধরনের বিশ্বাসের কিছু দৃষ্টান্ত আজও লক্ষ্য করা যায়। যেমন- জাপানের রাজ পরিবার সূর্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে বিশ্বাস।
জনসংখ্যা সম্পর্কে মতবাদ : মনুষ্য জগতের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে হার্বার্ট স্পেন্সার জীবজগতের বংশ বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। তাঁর মতে, মানবসমাজ যত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায়, ততই মানুষের বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা হ্রাস পায়। কেননা বিবর্তনের ফলে ব্যক্তিসত্তার উন্নয়ন সাধিত হয়। তাছাড়া বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা ও ব্যক্তিসত্তার স্বকীয়তা পরস্পর বিপরীতমুখী। তিনি বংশবৃদ্ধি ক্ষমতার হ্রাস প্রক্রিয়াকে Individuation বলে আখ্যায়িত করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, স্পেন্সার এর সামাজিক বিশ্লেষণ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সমাজে মানুষে মানুষে প্রভেদ থেকে সামাজিক অসমতার সৃষ্টি হয়েছে। এ অসমতা সমাজ উন্নয়নে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!