General Knowledge

সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে এমিল ডুর্খেইম এর অবদান আলোচনা কর।

অথবা, সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমিল ডুর্খেইমের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশে এমিল ডুরখেইমের অবদান আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে মানুষের জীবন যেমন সরল থেকে জটিল হয়েছে তেমনি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। সমাজের এ পরিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয় শাসক ও শোষক শ্রেণি। আর এ দাসত্বের বা শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণিকে মুক্ত করার প্রয়াসে আলোকবর্তিকা রূপে হাজির হন ফরাসি দার্শনিক এমিল ডুর্খেইম (1858–1917)।

সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডুর্খেইমের অবদান : বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর এমিল ডুর্খেইম এর অবদান অপরিসীম। তাই তো তাঁকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর গৃহীত বিভিন্ন পদ্ধতি ও তত্ত্ব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিক উপাদান (Social factor) : এমিল ডুর্খেইম বস্তুনিষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হবে সামাজিক উপাদান। তিনি তাঁর ‘The Rules of Sociological Method’ গ্রন্থে দু’ধরনের সামাজিক উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন । যথা :
বস্তুগত সামাজিক উপাদান (Material social factor) : সমাজের কাঠামোগত দিক (চার্চ, State), সমাজের বিভিন্ন স্তরায়িত কাঠামো, জনসংখ্যা বণ্টন, যোগাযোগের মাধ্যম, আইন ও আমলাতন্ত্র হলো বস্তুগত সামাজিক উপাদান অবস্তুগত সামাজিক উপাদান (Non-Material social factor): নৈতিকতা, সামাজিক বিবেক, যৌথ প্রতিনিধিত্ব, সংস্কৃতি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো অবস্তুগত সামাজিক উপাদান।
২. সমাজের শ্রমবিভাজন (Division of labour in society) : ডুর্খেইম এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে সমাজের শ্রমবিভাজনের তত্ত্বটি। তিনি তাঁর সামাজিক সংহতি বা যৌথ প্রতিরূপ দিয়ে সমাজের শ্রমবিভাজনের চেষ্টা করেছেন। সমাজে দু’ধরনের শ্রমবিভাজন রয়েছে। যথা :
ক. যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical solidarity) : ডুর্খেইম যান্ত্রিক সংহতি বলতে এমন সংহতিকে বুঝিয়েছেন, যেখানে সভ্যদের মধ্যে অনন্য সাদৃশ্য বিদ্যমান। এক্ষেত্রে সমাজে পরিবার, গ্রাম এবং ক্ষুদ্র এলাকার মধ্যে
শ্রমবিভাগ সীমাবদ্ধ ।
খ. জৈবিক সংহতি (Organic solidarity) : ডুর্খেইম আধুনিক সমাজের সংহতিকে সাংগঠনিক সংহতি বলেছেন, এখানে শ্রমবিভাজন খুবই জটিল। আধুনিক সমাজে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি থেকে ভিন্ন এবং ব্যক্তি চরিত্রের মধ্যে সাদৃশ্য অনুপস্থিত। ব্যক্তির বিভিন্নতা এ সমাজে পরিলক্ষিত হয়।
৩. আদর্শহীনতা (Anomie) : Anomie শব্দটি এসেছে Anony থেকে, যার অর্থ হলো State of normlessness. ডুর্খেইম Anomie আলোচনায় সার্বিক নৈতিকতার অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। ব্যক্তি Anomie এর মুখোমুখি তখনই হয় যখন সে বুঝতে পারে না যে, সে Anomie দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় না অর্থাৎ কোনটি করা উচিত এবং কোনটি করা উচিত নয় বা গ্রহণযোগ্য নয় সে সম্পর্কে ধারণার অভাব দেখা দেয়।
৪. আত্মহত্যা (The suicide) : ডুর্খেইম তাঁর “Third Famous’ গ্রন্থে “The suicide” এর সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রদান করেন। তিনি এন্থ সামাজিক সংহতির সাথে আত্মহত্যার সম্পর্ক আলোচনা করেন। আর আত্মহত্যাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডুর্খেইম একটি অবস্তুগত সামাজিক উপাদান তথা সামাজিক প্রবাহ এ প্রত্যয়টি ব্যবহার
করেন । তিনি তাঁর ‘The Rules of Sociological Method’ গ্রন্থে এ প্রত্যয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। ডুর্খেইম তিন ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেছেন । যথা :
ক. অহমিকাবাদী আত্মহত্যা (Egoist suicide) : মূলত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে যখন বাঁধন দুর্বল হয়ে যায়, তখন এক ধরনের আত্মহত্যা পরিলক্ষিত হয়, যাকে বলা হয় অহমিকাবাদী আত্মহত্যা। সাধারণত যে সমাজে সংহতি কম থাকবে, সে সমাজে অহমিকাবাদী আত্মহত্যা পরিলক্ষিত হবে।
খ. আদর্শহীন আত্মহত্যা (Anomie suicide) : ডুর্খেইম মনে করেন একটি সমাজে অর্থনৈতিক মন্দা, অর্থনৈতিক প্রাচুর্য ও বিভিন্ন কারণে যদি আদর্শহীনতা দেখা দেয়, তাহলে আদর্শহীন আত্মহত্যা সংঘটিত হয়।
গ. স্বার্থহীন আত্মহত্যা (Altruistic suicide) : ব্যক্তি যখন কোন সামাজিক উদ্দেশ্যে আত্মহত্যা করে, তখন তাকে স্বার্থহীন আত্মহত্যা বলা হয়। এখানে মূলত ব্যক্তির আত্মহত্যা সমাজের অন্য কারও দ্বারা নিবেদিত। “Suicide when there are socially enoyed.” ডুর্খেইম এ ধরনের আত্মহত্যার দু’টি উদাহরণ দেন । যথা :
ক.আদিম সমাজে যখন একজন বৃদ্ধলোক দলের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য Suicide করতো।
খ.স্বামীদের সাথে সহমরণের ঘটনাকে এ ধরনের Suicide বলা হয়।
৫. ধর্মীয় জীবনের উপাদান (The elementary forms of religious life) : ধর্ম সংক্রান্ত সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হলেন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম ‘The Elementary Forms of Religious Life’ গ্রন্থে ডুর্খেইম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর মতবাদকে সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করেছেন। Durkheim Primitive Society তে Mana বা অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন। Totem বা পবিত্র বংশচিহ্ন হলো আদিম মানুষের সামাজিক বা যৌথ জীবনযাত্রার নিদর্শন। Mana এবং Totem উভয়ই পবিত্র এবং উভয়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
৬. সামাজিক সংস্কার : ডুর্খেইম সামাজিক সংস্কার বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন সমাজের সমস্যা হচ্ছে নিরাময়যোগ্য, যার নিরাময় সম্ভব সামাজিক বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে। ডুর্খেইম এর মতে, “আধুনিক সমাজের সমস্যা হচ্ছে জৈবিক সমস্যা, যা সমাজকাঠামোতে সংস্কার সাধন করে দূর করা সম্ভব।
৭. পুঁজিবাদী সমাজ : ডুর্খেইম পুঁজিবাদী সমাজের সম্পদ কেমন হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি এ সমাজে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মার্কস পন্থিদের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তখনকার সামাজিক সংহতি সৃষ্টি হয়েছিল সামাজিক নৈতিকতার অভাব থেকে।
আর এ নৈতিকার সংহতি তখনই পূরণ করা যাবে যখন একই শিল্পের সকলে মিলে একই দল সৃষ্টি করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, ডুর্খেইম এর সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডুর্খেইম রক্ষণশীলতার সপক্ষে এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের এক ধরনের ক্রিয়াবাদী বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তিনি সামাজিক ঘটনাবলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে প্রত্যাখ্যান করেন। সমাজবিজ্ঞানে তাঁর এতৎসত্ত্ব অবদান থাকা সত্ত্বেও তিনি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তবুও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!