অথবা, মরিস জিলবার্গের সামাজিক কাঠামো সম্পর্কিত ধারণা ব্যাখ্যা কর।
.অথবা, সমাজ কাঠামোর মরিস জিলবার্গীয় ধারণা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হলো সমাজ কাঠামো। সমাজ কাঠামো হলো সমাজের সাংগঠনিক অখণ্ড সত্তা। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে। আর সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একেকটি একক, যার ভিত্তিতে আমরা সমাজ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। এজন্য আমরা বলতে পারি যে, সমাজ কাঠামো হলো সমাজকে তুলে ধরে এমন প্রধান প্রধান সামাজিক গোষ্ঠী ও অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের জটিল সমন্বয়।
সমাজ কাঠামো সম্পর্কে মরিস জিলবার্গের উক্তি : Ginsberg এর উক্তির আলোকে সমাজনকাঠামোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা যেসব ধারণা পাই তা হলো :নপ্রথমত, একই ব্যক্তির একাধিক সামাজিক পরিচিতি রয়েছে এবং সে অনুযায়ী তাকে সমাজে বিভিন্ন ভূমিকা রাখতে হয়। তাই সমাজস্থ মানুষের সামাজিক পরিচিতি এবং তৎসম্পর্কিত ভূমিকাকে সমাজ কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয়ত, সমাজস্থ মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ ছাড়াও সমষ্টিগত আচরণ রয়েছে এবং প্রয়োজনের তাগিদে তারাননানারকম স্থায়ী ও অস্থায়ী সংঘ গড়ে তোলে। সংঘে সুবিন্যস্ত আচরণ লক্ষ্য করা যায়। অতএব নানারকম সামাজিক
সংঘকেও সমাজ কাঠামোর অন্যতম উপাদান হিসেবে ধরা হয়। তৃতীয়ত, সামাজিক মানুষ নিয়মানুবর্তিতাপূর্ণ বিধিনিষেধ শাসিত সমাজে বাস করে এবং এ বিধিনিষেধগুলো সমাজকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। জীবনধারাগত বৈশিষ্ট্য এ বিধিনিষেধসমূহে প্রতিফলিত হয়। সেজন্য সব সমাজে একই প্রকার বিধিনিষেধ দেখা যায় না।বি ধিনিষেধসমূহের স্বরূপ না জানলে সমাজ কাঠামোর প্রকৃতি অনুধাবন করা যায় না। চতুর্থত, প্রত্যেক সমাজের স্বতন্ত্র মূল্যবোধ ও একটা জীবনদর্শন থাকে। সমাজে যা বাঞ্ছনীয় এবং আদর্শস্থানীয় হয়নতাই জীবনদর্শনের মূল উপজীব্য। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার আচরণ উভয়ই সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ও জীবনদর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। পঞ্চমত, যে কোন সমাজ কাঠামো সম্পর্কে জানতে হলে সমাজের অন্তর্ভুক্ত দল, শ্রেণি, জাতি, গোষ্ঠী এবং তাদের স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কর্মকে জানতে হবে। কারণ এগুলোর উপর ভিত্তি করেই সমাজের স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়, যার মাধ্যমে সমাজ টিকে থাকে। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে সমাজ গড়ে তোলে। প্রতিটি সমাজেই গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠাননরয়েছে। নিম্নে গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
গোষ্ঠী : যখন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কতকগুলো লোক একত্রিত হয় তাকে গোষ্ঠী বলে। গোষ্ঠী হলো বৃহৎ বা ক্ষুদ্র এমননএকটি দল, যার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে এমন একটি সম্পর্ক, যা দলের সদস্যদেরকে একই সূত্রে গ্রথিত করে (Small)। কুলির (Cooley) মতে, গোষ্ঠী দু’ভাগে বিভক্ত। যথা :
ক. প্রাথমিক গোষ্ঠী (Primary group): Primary group এ কেউ কেউ রক্তের কথা বলেছেন, যেমন—নপরিবার। এছাড়া খেলার দল, পাড়াপড়শি হলো মুখ্য গোষ্ঠীর এক একটি উদাহরণ। মুখ্য গোষ্ঠীসমূহকে সভ্যতার বিভিন্ন রূপে দেখা যায় ।
খ. মাধ্যমিক গোষ্ঠী (Secondary group) : Secondary group এ কোন মুখোমুখি সম্পর্ক থাকে না। সমাজের মানুষের নানাবিধ উদ্দেশ্য ও আগ্রহ নানারূপ গৌণ গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। যেমন- শ্রমিক সংঘ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি দপ্তর, রঙ্গমঞ্চ ইত্যাদি। এগুলোর স্বরূপ সমাজ কাঠামোর স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে।
প্রতিষ্ঠান : মরিস জিন্সবার্গ এর মতে, “সমাজ কাঠামো আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (MacIver) ও প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রতিষ্ঠানকে তিনি সমাজের চাকা হিসেবে অভিহিত করেছেন।” আমরা দেখতে পাই প্রতিটি সমাজেই কতকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে । যথা :
১. সামাজিক প্রতিষ্ঠান (Social institution) : পরিবা র এবং বিবাহ প্রথা অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পরিবারই হচ্ছে আদিম ও মূল্যবান। পরিবারের ভিত্তি হলো বিবাহ প্রথা। তাই কোন সমাজেনবসবাসরত মানুষগুলোর মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক কিরূপ তা জানতে হলে সে সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের জানতে হবে।
২. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Political institution) : রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠান। রাজনীতি নিয়েনযেসব প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখে সেগুলোর মধ্যে রাষ্ট্র ও সরকার অন্যতম। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হলো শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ইত্যাদি। তাও কোন সমাজকে তথা সমাজ কাঠামোকে জানতে হলে সে সমাজে কি ধরনের শাসনব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, রীতিনীতি ছিল তা জানতে হবে।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational institutions) : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। এগুলো মানুষকে সুনাগরিক হতে সাহায্য করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সামাজিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার শিক্ষা পায়।
৪. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (Economic institution) : জীবন বীমা, ব্যাংক ইত্যাদি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ কাঠামো রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সমাজ কাঠামোর মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হলো সম্পত্তি, উৎপাদন ব্যবস্থা, বণ্টন ব্যবস্থা ইত্যাদি। তাই কোন সমাজের
সমাজ কাঠামোকে জানতে হলে সে সমাজের সম্পত্তির স্বরূপ, উৎপাদন ব্যবস্থার স্বরূপ ইত্যাদি জানতে হবে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে পর্যালোচনা করতে হবে। সমাজে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। এ কারণেই Ginsberg অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে সমাজ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
৫. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (Religious institution) : মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ তার নিজ ধর্মপালন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর আপন সত্তা খুঁজে পেতে পারে। Marx একে সমাজ কাঠামোর Super structure এবং Weber একে Basic structure হিসেবে চিহ্নিত করেন।
৬. চিত্তবিনোদন (Recreation) : ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত Karl Marx এর মতে, “মানব সংস্কৃতির সকল স্তরেই মানুষের অবসর বিনোদনের ক্ষেত্রে খেলাধুলা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।” সামনার ওনকোলারের মতে, “এটা সকল সমাজে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে নি।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য দিয়ে সমাজমক্রিয়াশীল বা গতিশীল থাকে। এর মধ্যে মানুষ নিজের ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতন হয়। আর এগুলোর মাধ্যমেই যে কোন সমাজব্যবস্থার কাঠামোগত চিত্র পাওয়া যায়। বর্তমানে আধুনিক সমাজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিল্পকলা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিলক্ষিত হয়। কাজেই আমরা বলতে পারি যে, সমাজ কাঠামো সম্পর্কে Ginsberg প্রদত্ত সংজ্ঞা যথার্থই প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবধর্মী।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%ae/
admin

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!