সমাজকাঠামোর মার্কসীয় তত্ত্ব পর্যালোচনা কর ।
অথবা, সমাজকাঠামোর অজৈবিক ধারণা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজ কাঠামো সমাজবিজ্ঞানের একটি মৌলিক প্রত্যয়। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ভিত্তিতে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে। সমাজ কাঠামো এমন একটা প্রত্যয় যেখানে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ, গোষ্ঠী, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান স্ব-স্ব ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সমাজ কাঠামো গড়ে তোলে। মার্কসীয় সমাজ কাঠামো সবসময়ই উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তরে সমাজ কাঠামোর প্রকৃতি বিভিন্ন হবে বলে মার্কস মন্তব্য করেন।
মার্কসীয় সমাজ কাঠামোর মূল বক্তব্য : Marx এবং তাঁর অনুসারীগণ সমাজ কাঠামোর ব্যাখ্যায় অজৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে স্থিতিশীল সত্তা হিসেবে দেখা হয় না, বরং সমাজ
ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার উদ্ভূত ফসল হিসেবে মনে করা হয়। মার্কস তাঁর ‘Contribution to the Critique of Political Economy’ (1856) তে বলেন, “মানুষ যে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ তার মধ্যে সে নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের আঙ্গিকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। উৎপাদন সম্পর্কগুলো অপরিহার্য এবং ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ। এ উৎপাদন সম্পর্কগুলো উৎপাদনের বস্তুগত শক্তিসমূহের বিকাশের সুনির্দিষ্ট স্তরের প্রতিষঙ্গিক। উৎপাদন সম্পর্কসমূহের যোগফল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করে। এটি সমাজের প্রকৃত ভিত্তি, যার উপর তৈরি হয় আইনি ও রাজনৈতিক উপরি কাঠামো এবং প্রতিষঙ্গিক নির্দিষ্ট সামাজিক চেতনা। অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সমগ্র উপরি
কাঠামোর পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।” উপর্যুক্ত বক্তব্যের মাধ্যমেই সমাজ কাঠামোর রূপ সম্পর্কে মার্কস যা বলেছেন তা ফুটে উঠে। এখানে সমাজ কাঠামোর দুটি দিক স্পষ্ট । যথা :
১. অর্থনৈতিক কাঠামো যাকে মৌল কাঠামো বা (Basic structure) বলা হয়ে থাকে ।
২. উপরি কাঠামো (Super structure) যা বস্তুত মৌল কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। প্রথমেই আমাদের জানা উচিত মার্কস অর্থনৈতিক কাঠামো এবং উপরি কাঠামো বলতে কি বুঝিয়েছেন। মার্কসের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তিনি মানুষের বস্তুগত জীবন বা উৎপাদন পদ্ধতিকে মৌল কাঠামো এবং মানুষের চৈতন্য ও ভাবনা প্রসূত বিষয়গুলোকে উপরি কাঠামো বলেছেন। মার্কস সমাজজীবনকে রূপক অর্থে সৌধের সাথে তুলনা করেছেন। সৌধ যেমন তার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি ব্যক্তির মননশীলতা, চিন্তাশীলতা, জ্ঞানমণ্ডল সমাজের বস্তুগত জীবনের উপর দণ্ডায়মান। আবার বস্তুগত জীবনের পরিবর্তনের ফলে সমাজের উপরি কাঠামোর পরিবর্তন হয়।
অর্থনৈতিক বা মৌল কাঠামো : মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে তিনি সমগ্র উৎপাদন শক্তি, উৎপাদন সম্পর্ক বা শ্রেণি সম্পর্ককে বুঝিয়েছেন। উৎপাদনের যন্ত্রের মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণির সম্পর্ককে তিনি সমাজ কাঠামোর ভিত্তি বলে চিহ্নিত করেছেন। উৎপাদনের উপায় যেমন- যন্ত্রপাতি,
শ্রম, দক্ষতা, প্রযুক্তি ইত্যাদি হলো উৎপাদন শক্তি। অন্যদিকে, উৎপাদন উপায়ের সম্পর্ক, সম্পদের মালিকানা ইত্যাদি হলো উৎপাদন সম্পর্ক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কসীয় সমাজ কাঠামোর মানুষ যে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে পরস্পরের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। মার্কসীয় সমাজ কাঠামোয় উৎপাদন সম্পর্কসমূহের যোগফল সমাজে অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করে। এটি সমাজের প্রকৃত ভিত্তি, যার উপর তৈরি হয় আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামো। অতএব আমরা পরিশেষে বলতে পারি যে, সমাজ কাঠামোয় মার্কসীয় তত্ত্বটি অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন ও উপরি কাঠামো পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।