সমাজকাঠামোর জৈবিক ধারণা আলোচনা কর ।
অথবা, সমাজকাঠামোর অমার্কসীয় তত্ত্ব পর্যালোচনা কর।
অথবা, সমাজকাঠামোর জৈবিক তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ‘Structure’ বা কাঠামো শব্দটি প্রথমে বাড়িঘর বা দালানকোঠা তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জীববিজ্ঞানের জনক চার্লস ডারউইন জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ শব্দটি প্রবর্তন করেন। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হার্বার্ট স্পেন্সার সমাজবিজ্ঞানে এ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৫ সাল থেকে সমাজবিজ্ঞানে ‘সমাজ কাঠামো’ প্রত্যয়টি একটি নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে।
জৈবিক ধারণার মূলবক্তব্য : হার্বার্ট স্পেন্সার, রেডক্লিফ ব্রাউন, ম্যালিনোস্কি প্রমুখ সমাজ কাঠামোর জৈবিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ধারণানুসারে, “Society is treated as a kind of living creature, the parts of which can be dissected and distinguished. The social structure is the mesh of mutual positionsনand interrelations in terms of which the interdependence of the component parts may be described.” উক্ত ধারণাটি রেডক্লিফ ব্রাউন সর্বপ্রথম প্রকাশিত করেন। এ বক্তব্য অনুযায়ী মানবসমাজ একটি ‘Organism’ বা প্রাণী ব্যতীত অন্য কিছু নয়। সমাজের বিভিন্ন উপাদান জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ । একে আবার পৃথকও করা যায়। সমাজ কাঠামো হলো সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কের এমন এক জালবিশেষ যেসবের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বর্ণনা করা যায়। মূলত জৈবিক ধারণার ঐতিহাসিক বিকাশের প্রেক্ষিতে সমাজ কাঠামোকে বিবেচনা করা হয় না, বরং স্থিতিশীল সমাজ কাঠামোকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানে সমাজকে বিকাশশীল প্রাণীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। মূলত জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তিন জন সমাজবিজ্ঞানীরনমতানুসারে দেখা হয়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
হার্বার্ট স্পেন্সারের (H. Spencer) মতামত : স্পেন্সার মূলত ডারউইন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণে জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য নেন। তিনি সমাজকে জীবদেহের সাথে তুলনা করেন এবং সমাজ কাঠামো বিশ্লেষণে জীবের দৈহিক কাঠামোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের উপর গুরুত্ব দেন। অর্থাৎ তিনি জীবের দৈহিক কাঠামো
বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সমাজ কাঠামো বিশ্লেষণের পক্ষপাতী। তাঁর মতে, জীবদেহ যেমন অজৈবিক থেকে জৈবিক তারপরমঅধিজৈব (From inorganic to organic then to super organic) সত্তায় বিকাশ লাভ করে, তেমনি সমাজও সরল হতে জটিল সমাজে বিবর্তিত হয়েছে। তাঁর মতে, জৈবিক সত্তার যেমন বিবর্তন ঘটেছে, তেমনি অধিজৈব সত্তায় সমাজ সমসত্তাবিশিষ্ট সরল রূপ (Homogeneous) থেকে অসম জটিল সমাজে (Heterogeneous) পর্যবসিত হয়েছে। এভাবেই তিনি সমাজ কাঠামো ব্যাখ্যা করেছেন।
রেডক্লিফ ব্রাউনের মতামত : ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে ‘ডুরখেইমের সমাজতত্ত্ব’ সম্পর্কিত বক্তৃতামালায় ‘সামাজিক কাঠামো’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। সমাজ কাঠামো সম্পর্কিত জৈবিক মতবাদটি উক্ত প্রবন্ধে পাঠ করা হয়। তাঁর মতে, সমাজ কাঠামো একটি ‘Organism’ ছাড়া অন্যকিছু নয়। এ কাঠামোর বিভিন্ন উপাদান জীবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আবার জীবদেহের মতোই সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন উপাদানকে পৃথক করা যায়। তিনি আদিম সমাজের প্রেক্ষিতে সমাজ কাঠামো সম্পর্কিত উল্লিখিত মতামত প্রকাশ করেন। এখানে মূলত স্থিতিশীল সমাজ কাঠামোকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ম্যালিনোস্কির (Malinowski) মতামত : ম্যালিনোস্কিও ব্রাউনের মতো সমাজ কাঠামোর ব্যাখ্যায়মউল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনিও ব্রাউনের মতো সমাজকে একটি ‘Organism’ হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে, জীবদেহ যেমন বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যাবলি ও সেসবের পারস্পরিক সম্পর্কের এক জটিল ব্যবস্থা, তেমনি সমাজেও রয়েছে ক্রিয়াশীল ও
পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি গোষ্ঠীর সমাহার। তাই তিনি সমাজ কাঠামো পাঠে জীবদেহের অ
ঙ্গপ্রত্যঙ্গের সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এভাবেই আমরা সমাজ কাঠামোর জৈবিক বা অমার্কসীয় ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে পারি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সমাজ কাঠামো সম্পর্কিত জৈবিক ধারণায় সমাজকে জীবদেহের কার্য এবং ক্রমবিকাশের সাথে তুলনা করা হয়েছে। জৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সমাজ কাঠামো হলো ঐতিহাসিক রূপান্তরের ফল।