শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন চেতনা ব্যাখ্যা কর ।
অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন চেতনা আলোচনা কর।
অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন চেতনা বর্ণনা কর।
অথবা, শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন চেতনা বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : মধ্যযুগের বাংলা পদাবলী সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ধারায় যে বাঙালি মনীষীর অবদান সর্বাগ্রে প্রণিধানযোগ্য তিনি হলেন চণ্ডিদাস। তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক কবি হিসেবে পরিচিত। বাংলায় পদাবলী সাহিত্যের প্রবর্তক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি সমধিক। যদিও চণ্ডিদাস নামটি নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রহস্যের অন্ত নেই তথাটি চণ্ডিদাস বলতে আমরা মূলত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডিদাসকেই বুঝি, চণ্ডিদাদের সামগ্রিক চিন্তা চেতনার একমাত্র উৎস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। ১৯১৬ সালে বাঁকুড়া থেকে আবিষ্কৃত এ কাব্যটিতেই তাঁর
সামগ্রিক চিন্তা চেতনা ও ধ্যানধারণা বিধৃত হয়ে আছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই এ কাব্যের মূল উপজীব্য। তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে শুধু রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাই বর্ণিত হয়েছে তা নয়, বরং রাধাকথার তত্ত্বকথা যেমন অস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে তেমনি মানবতাবাদী আদর্শেরও স্ফূরণ ঘটেছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন চেতনা : মানবতাবাদী দর্শনাদর্শ বলতে মানুষ, মানবতা ও মানবিক বিষয়াদির সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিতির তরে নিবেদিত দৃষ্টিভঙ্গিকেই বুঝায়। অর্থাৎ মানুষ এবং মানবতার সার্বত্রিক কল্যাণই মানবতাবাদের মূল কথা। অন্যভাবে বলা যায় মানবিক বিষয়াদির প্রতি আগ্রহ ও মনুষ্যকল্যাণকর নীতিজাত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে মানবতাবাদ। ইউরোপে মানবতাবাদী দার্শনিক আদর্শের উদ্ভব রেনেসাঁর ফসল হলেও বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মানবতাবাদী চিন্তার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। উপমহাদেশীয় চিন্তায় বিকশিত এ মানবতাবাদী আদর্শের একটি সুস্পষ্ট প্রতিফলন আমরা দেখতে পায় চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী আদর্শের চেতনা নিম্নরূপ :
দেব ও মানবের সহাবস্থান : চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধাকৃষ্ণের চক্রলীলার মাহাত্ম্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফলে
স্বাভাবিকভাবেই এ কাব্যে দেবতার আসন সবার উপরে। কিন্তু এ কাব্যে দেবতা কৃষ্ণের পাশাপাশি মানব রূপী রাধার প্রেমলীলা মানুষের স্থানকেও অনেক উপরে নিয়ে গেছে। মর্ত মানবী রাধা চরিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়েই চণ্ডিদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে মানবতাবাদী আদর্শের স্ফূরণ ঘটিয়েছেন। তিনি কৃষ্ণ ও রাধা তথা দেবতা ও মানবী উভয়কেই মর্তের বাসিন্দা হিসেবে সহাবস্থানে উপস্থাপিত করেছেন। এ কাব্যে রাধিকা ও কৃষ্ণ, লক্ষ্মী ও নারায়ণ, কংস বধের জন্য দেবতাদের প্রার্থনায় মানবরূপে মর্তে গ্রহণ করলেন। মর্ত জীবনে কৃষ্ণ তার পূর্বজন্মের দেব সত্তা স্মরণে রাখলেও রাধা আত্মবিস্মৃতা হলেন তার পূর্ববর্তী দেবী জীবনের সর্বমাহাত্ম্য ও ঐশ্বয্য। কৃষ্ণ যশোদার পুত্র হয়েও সপ্ত লাখের বাঁশির
অধিকারী, আর রাধা সাগর গোয়ালার কন্যা, আনন্দ ঘোষের স্ত্রী, সর্বপ্রকার মানবিক সীমায় সীমাবদ্ধ। সংসার ধর্মী রাধা অন্যের স্ত্রী, কৃষ্ণের প্রেমাহ্বানে সে সাড়া দিতে পারে না। কৃষ্ণ সম্পর্কে তার ভাগিনা তাই বার বার সে আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক এটিই তার মানব ধর্ম। এ মানব ধর্মেরই প্রকাশ করেছেন চণ্ডিদাস তার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। দেব চরিত্র কৃষ্ণের পাশে মানবী চরিত্রের রাধার এই উজ্জ্বল উপস্থিতিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মানবতাবাদী দর্শন আদর্শের সরল প্রকাশ স্বরূপ।
দেবতার মানবীকরণ : বিদ্যাপতি যেমন তাঁর গীতিকাব্যে তেমনি চণ্ডিদাসও তাঁর শ্রীকৃ
ষ্ণকীর্তন কাব্যে দেবতার মানবীকরণ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধা কৃষ্ণকে দেবতারূপে নয় মানব মানবীরূপেই চণ্ডিদাস উপস্থাপন করেছেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেম পার্থিব এতে অপার্থিব কিছু তেমন একটা নেই। চণ্ডিদাস সাধারণ্যের জীবন ও প্রেমানুভূতিকে আশ্রয় করেই রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলাকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। রাধা ও কৃষ্ণ যেন তাঁর বর্ণনায় আর দশটা সাধারণ মানব মানবীর প্রতিচ্ছবি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা যেন আবহমান বাংলার একজন সাধারণ নারী যার ঘরসংসার আছে,সংস্কার আছে, সমাজ ও লোকলজ্জা আছে, কুল হারানোর ভয় আছে। লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ, লোভ, ক্ষোভ আচার, মানবিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধাকে অধিকতর মানবিক গুণাবলিতে ভূষিত করেছে। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ দেবতা হলেও কবি কাব্যের কোথাও দেবশক্তি ব্যবহার করেননি। দেবতা শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছা করলে তাঁর যে কোনো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারতেন। কিন্তু এ কাব্যে আমরা কৃষ্ণকে দেখি ভিখারির ন্যায় মানবরূপী রাধার প্রণয় প্রার্থী হিসেবে। রাধার প্রেম প্রাপ্তির জন্য কৃষ্ণ রাধার ভার বহন করতে, মাথায় ছাতি ধরতে, নৌকায় পারাপার করতে, নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে কালিনাগকে দমন করতেও দ্বিধা করেননি। কৃষ্ণ চরিত্রে এই দুর্বল উপস্থাপনা তার দেবমাহাত্ম্য ক্ষুণ্ন করলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তার মানবমহিমাকে আমাদের সামনে চিরভাস্বর করে তোলে। এখানেই স্পষ্ট হয়ে উঠে চণ্ডিদাসের মানবতাবাদী দার্শনিক চেতনার আবেদন।
অসাম্প্রদায়িকতা : শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের অসাম্প্রদায়িক আবেদন চণ্ডিদাসের মানবতাবাদী দার্শনিক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ। সম্পূর্ণ এক অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী মনোবৃত্তি নিয়েই চণ্ডিদাস রচনা করেছিলেন তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। তাঁর কাব্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমতত্ত্ব বিধৃত হলেও জীবন কিভাবে শিবে উপনীত হতে পারে পরোক্ষভাবে তারই নির্দেশ করা হয়েছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও সংকীর্ণ চিন্তা চেতনামুক্ত মানবতাবাদী ও জীবনমুখী এক দৃষ্টিভঙ্গি চণ্ডিদাস উপস্থাপন করেছেন তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। চণ্ডিদাস মধ্যযুগের এমন এক সময়ে কাব্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন যখন বাংলার সমাজ ছিল বর্ণবিভেদের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাবল্য, সংস্কার, কঠোরতা ও সংকীর্ণতা দূরে ঠেলে দিয়েছিল মানবধর্ম ও জনজীবনকে। সমাজ জীবনের এরূপ অস্থিরতার পরিবেশে চণ্ডিদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে গাইলেন সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার গান। এই কাব্যে তিনি সমসাময়িক সমাজ চিন্তার বিপরীতে উত্তম ও অধমের সমন্বয়ে দেব ও মানবীর প্রেম, অভিজাত ও সাধারণের মিলনকে প্রচ্ছন্নভাবে প্রেমের মাধ্যমে উপস্থাপন ও স্বীকৃতি প্রদানে মৃগপৎ প্রয়াস নেন। আর তাঁর এ প্রয়াসই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যকে বাঙালির দর্শনের ইতিহাসে মানবতাবাদী চিন্তার আদি নিদর্শনগুলোর মধ্যে উৎকৃষ্টতম একটি হিসেবে স্বীকৃতি দান করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” মানবতাবাদের এ তিনি তাঁর কাব্যে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে কোনো ঐশ্বরিক বা অপার্থিব রূপদান করেননি। বরং সাধারণ মানুষের হাসি কান্না,অবসর বাণীর প্রবক্তা চণ্ডিদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে মানবিক আদর্শের চেতনাকেই ধারণ করেছেন সর্বান্তকরণে। তাইতো -দুঃখ, লজ্জা ভয়, জাত, কুল, মান ইত্যাদি সমন্বিত মর্ত মানব মানবীর প্রেম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তাইতো তিনি উঠতে পেরেছেন বাঙালি চিন্তার মানবতাবাদী আদর্শের আদি পুরুষ।