শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা আন্দোলনের কারণ ও প্রতিক্রিয়া আলোচনা কর।
অথবা, শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই শাসনতন্ত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় শাসনে তাদের সংখ্যাধিক্য সর্বাধিক ছিল। এ সময় প্রদেশের উপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যধিক। ফলে প্রদেশে শোষণের চিত্র প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষকরে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শোষণ তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় বাঙালির শোষণ-মুক্তির ইশতেহার প্রণয়ন করেন শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছয়দফা কর্মসূচি নামে পরিচিত।
শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা আন্দোলনের কারণ : পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ গঠন, দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ
করতেন। গভর্নর জেনারেল “The Pakistan Provincial Constitution (Third Amendment Order, 1948” এর মাধ্যমে এ নিয়ন্ত্রণ করতেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে ‘Public and Representative Offices Disqualification Act’ জারির মাধ্যমে প্রাদেশিক মন্ত্রীদের কার্যত পরাধীন করে রাখা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্যগণ ছিলেন পাকিস্তানি। তারা প্রদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের চাকরি নিয়ন্ত্রণ করত কেন্দ্রীয় সরকার। সুতরাং তাদের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না; আবার কেন্দ্রকে সন্তুষ্ট করে তারা শক্তিশালী আমলায় পরিণত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে কেন্দ্র প্রদেশের উপর নির্ভরশীল থাকলেও উন্নয়নের ব্যাপারে কেন্দ্রকে প্রাধান্য দিত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় প্রদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়। ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠতে থাকে এবং তা জোরালো রূপ ধারণ করে। আর তাই শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয়দফা আন্দোলনের সূচনা করেন।
ছয়দফা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া : ছয়দফা দাবি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ তারা প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে মুদ্রা ন্যস্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করেছিল। তারা কোনভাবেই কেন্দ্রের ক্ষমতা হ্রাস পাবে সেটা চায়নি। প্রাদেশিক মিলিশিয়া গঠন তাদের শঙ্কিত করে তোলে। আর প্রদেশের হাতে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব অর্পণকে তারা গ্রহণ করেননি, কারণ তাদেরকে প্রদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। ছয়দফার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তার অনুসারীরা কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা থেকে মাওলানা তর্কবাগীশ স্বায়ত্তশাসন এর বিরোধিতা করে সভা ত্যাগ করেন। শেষ মুজিবুরের সাথে আরো অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি একটি সর্বজনীন দাবিতে
পরিণত হয়। কিন্তু ছয়দফা দাবির প্রচারণা করতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে ৮ মে ১৯৬৬ সালে গ্রেফতার করা হয় এবং ১০ মে এর মধ্যে প্রায় ৩৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবিতে সারাদেশে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। দেশের শ্রমিক শ্রেণি প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ছয়দফার দাবি বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে স্বীকৃতি পায় । দেশজুড়ে আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট চলতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালির স্বাধিকার প্রশ্নে ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবোধ পূর্ণতা লাভ করে। সকল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে এ আন্দোলনে।