General Knowledge

যুক্ত পাকিস্তানের সমস্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা,যুক্ত পাকিস্তানের সমস্যাবলি তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ভারতীয় উপমহাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। কারণ প্রায় ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট এবং ১৫ আগস্ট ভারত
উপমহাদেশে জন্ম হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান কিন্তু এর ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অদ্ভুত প্রকৃতির। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় ১২০০ মাইল। তাছাড়া পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে একটি অস্পষ্টতা লক্ষ করা যায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে। এ অবৈজ্ঞানিক বিভাজনের ফলেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে ভারত বিভাগের অনিবার্য ফলস্বরূপ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
যুক্ত পাকিস্তানের সমস্যাবলি : যুক্ত পাকিস্তানের যেসব সমস্যাবলি তার পিছনে ছিল এদের মধ্যে নিম্নোক্তগুলো অন্যতম :
১. ভাষাগত সমস্যা : যুক্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল বাঙালি যা মোট জনসংখ্যার ৫৬% এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা । কিন্তু পাঞ্জাবিরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও জোরপূর্বক বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়। এ অন্যায় আচরণকে বাঙালিরা বরদাস্ত করে নি। তারা মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলন পরিচালনা করে। বাংলার সর্বস্তরের মানুষ মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাক শাসকদের শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে নেমে আসে।
২. ধর্মীয় সমস্যা : মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদেরকে প্রকৃত মুসলমান বলে স্বীকার করতে নারাজ ছিল। ফলে ধর্মীয় ঐক্য থাকলেও পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন।
৩. ভৌগোলিক কারণ : পাকিস্তান বিভক্তির পিছনে ভৌগোলিক অবস্থানও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা প্রায় ১২০০ মাইলের ভারতীয় ভূমি দ্বারা বিভাজিত দুটি পৃথক এলাকাকে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা কেবল বোকামিই নয়, অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব ছিল। ফলে তার পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে এবং পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
৪. যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন : যুক্তফ্রন্টে যে চারটি দল অন্তর্ভুক্ত ছিল তা হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী ও বামপন্থী গণতন্ত্রী দল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মূলমন্ত্র ছিল ঐতিহাসিক ২১ দফা। নির্বাচনে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্ট ২২৮টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২০৬টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে (সংরক্ষিত মহিলা আসন ছাড়া)। কিন্তু পাক শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা দিতে গড়িমসি করে। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছিল, তবুও বিভিন্ন অজুহাতে ঐ সরকার টিকে থাকতে পারেনি।
৫. রাজনৈতিক সমস্যা : পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানিদের দারিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। এজন্য তারা প্রয়োজনে রাজনৈতিক নিপীড়নও চালাত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন, আগরতলা মামলা ও ‘৬৯ গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি প্রভৃতিই মূলত পাকিস্তান ভাঙনের পিছনে মূল শক্তি।
৬. সাংস্কৃতিক বৈষম্য : উভয় অংশের সংস্কৃতি, জীবনধারা প্রভৃতি ভিন্ন ছিল, এমনকি এক প্রদেশের লোকজন অন্য প্রদেশের লোকজন সম্পর্কে কিছু জানত না। ফলে তাদের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ ছিল সীমিত।
৭. অর্থনৈতিক সমস্যা : উভয় অঞ্চলের মধ্যকার অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল চরম। উভয় অংশের মাথাপিছু আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। পুরো পাকিস্তানের ব্যবসায় বাণিজ্য, ব্যাংক, বিমা সবই পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণ করতো। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণের মনে আশার সঞ্চার করেছিল সত্য কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের জন্ম না হওয়ার দরুন পূর্ববঙ্গের জনগণ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ফলে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!