General Knowledge

মর্যাদার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।

অথবা, শ্রেণির ভিত্তিতে মর্যাদাকে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানবজীবনে মর্যাদা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেকেই স্বীয় মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন। মানুষ সামাজিক জীব। আর এ মর্যাদা হলো সমাজেরই সৃষ্টি। সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক মানুষেরই একটা সামাজিক পরিচিতি বা সামাজিক অবস্থান রয়েছে। আর এ সামাজিক পরিচিতি বা অবস্থানই হলো মর্যাদা। যেমন- সমাজে কোন একজন ব্যক্তি কারও পুত্র, কারও স্বামী, কারও বাবা আবার কারওবা বন্ধু।
মর্যাদার শ্রেণিবিভাগ : মানুষের মর্যাদা লাভের প্রকৃতি অনুসারে সমাজবিজ্ঞানে মর্যাদাকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে । যথা : (ক) আরোপিত মর্যাদা ও (খ) অর্জিত মর্যাদা।
নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
ক. আরোপিত মর্যাদা : সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, বিধিনিষেধ তথা সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বংশানুক্রমিক বা ঐতিহ্যগতভাবে তথা জন্মসূত্রে মানুষ যে মর্যাদা লাভ করে তাকে আরোপিত মর্যাদা বা Ascribed status বলে। এরূপ মর্যাদার উপর মানুষের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ না হাত নেই। এ মর্যাদার জন্য মূলত দায়ী তার জন্ম। আরোপিত মর্যাদার প্রাধান্য, প্রতিপত্তি এবং প্রভাব প্রাচীন সমাজে অত্যধিক ছিল। আধুনিক গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ ধরনের মর্যাদার প্রাধান্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে কিংবা প্রাধান্য নেই বললেই চলে।আরোপিত মর্যাদা অত্যন্ত দুষ্পরিবর্তনীয়। বিশেষ করে শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় এ কথা অনস্বীকার্য। যেমন- একজন ব্যক্তি যদি ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তবে তার পরিচয় ক্ষত্রিয় হবে এবং সে সমাজে ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা পাবে ও সারাজীবন ক্ষত্রিয় মর্যাদা ভোগ করবে। আরোপিত মর্যাদার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এ মর্যাদার স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা আছে। এ প্রসঙ্গে কিংসলে ডেভিস (Kingsley Davis) তাঁর Human Society শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, “Ascribed status gives a feeling of security that purely achieved positions can never give.” মানুষ সামাজিক বর্ণবিন্যাস বা জাতিভেদ, বংশ বা পরিবার, লিঙ্গ এবং বয়সভেদে আরোপিত মর্যাদা লাভ করে থাকে এবং এসব কারণেই আরোপিত মর্যাদার তারতম্য ঘটে থাকে। যেমন- একজন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বর্ণে জন্মগ্রহণ করলে স্বাভাবিক কারণেই সে বৈশ্য বর্ণে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির তুলনায় অধিক মর্যাদার অধিকারী হবে। সমাজে সে উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি পাবে। আবার যারা অভিজাত বা বিখ্যাত বংশ কিংবা পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তারা নিম্নশ্রেণীর বংশ বা পরিবার অপেক্ষা অধিকতর উন্নত মর্যাদার অধিকারী হয়। একইভাবে লিঙ্গ এবং বয়সভেদেও আরোপিত মর্যাদায় এ ধরনের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন- সমাজে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা অধিকতর মর্যাদার অধিকারী হয় এবং পুরুষদেরকে অধিক মূল্যায়ন করা হয়। বস্তুত আরোপিত মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে ব্যক্তির জন্ম এবং সামাজিক প্রথা বিশেষভাবে দায়ী। এ ধরনের রীতি ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ও প্রতিভাকে ব্যাহত করে ও অবমূল্যায়িত করে। আধুনিক
সমাজে আরোপিত মর্যাদার প্রাধান্য যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে এবং পাচ্ছে।
খ. অর্জিত মর্যাদা : যে মর্যাদা মানুষ তার ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং কীর্তিকলাপের দ্বারা অর্জন করে তাকে অর্জিত মর্যাদা বা Achieved status বলে। এরূপ মর্যাদা অর্জনের পিছনে ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দক্ষতা, উদ্যোগ, কর্মক্ষমতা কর্মপ্রচেষ্টা, প্রতিভা-প্রবণতা, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ইত্যাদি বিদ্যমান থাকে। আধুনিক সমাজে অর্জিত মর্যাদার গুরুত্ব ও প্রাধান্য অত্যধিক। এ প্রকারের মর্যাদাকে বর্তমানে অধিক মূল্যায়ন করা হয়। ব্যক্তি এবং সমাজভেদে অর্জিত মর্যাদার তারতম্য দেখা যায়। যেমন- সবাই সমান প্রতিভা ও বিদ্যা-বুদ্ধির অধিকারী হয় না কিংবা সবার ব্যক্তিগত গুণাবলির বিকাশ সমভাবে হয় না অথবা প্রত্যেকের দক্ষতা-যোগ্যতা, কর্ম প্রচেষ্টা সমান নয়। এ কারণে সবাই একইরূপ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে না। সে কারণে সমাজে কেউ ডাক্তার, কেউ শিক্ষক, কেউ আইনজীবী আবার কেউবা গায়ে-গতরে শ্রমিক। অপরদিকে, যে সমাজে ব্যক্তির প্রতিভা বিকাশের সুযোগ উন্মুক্ত সে সমাজের মানুষ, রক্ষণশীল সমাজ হতে সহজে উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে। উন্মুক্ত সমাজে অর্জিত মর্যাদাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। আধুনিক যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে যে সমাজে ব্যক্তিগত প্রতিভা ও কর্মপ্রচেষ্টা বিকাশের সুযোগ যত বেশি উন্মুক্ত এবং অনুকূল, সে সমাজ জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় তত অগ্রবর্তী। আর এরূপ সমাজই উন্নত ও সমৃদ্ধ। এ ধরনের সমাজে ব্যক্তির অর্জিত মর্যাদার গুরুত্ব অত্যধিক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মর্যাদা মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য মানুষের আকুতির শেষ নেই। সমাজে অনেকেই বিষয়-সম্পত্তির বিচার বিবেচনাকে উপেক্ষা করে মর্যাদাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। মর্যাদা মানুষের জীবনের একটি সামগ্রিক বিষয়। মানুষ দুটি উপায়ে মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। একটি হলো জন্মসূত্রে ও সামাজিক প্রথা অনুসারে ঐতিহ্যগতভাবে এবং অন্যটি হলো ব্যক্তিগত গুণাবলির মাধ্যমে। মানুষ যেভাবেই মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন মর্যাদা মানবজীবনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং মূল্যবান বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!