মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা কী? এর ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
অথবা, ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যেসব প্রস্তাব দেওয়া হয় তার মধ্যে যে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম ভারতবাসী তাদের পরাধীনতার গ্লানি থেকে উত্তরণের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন করে। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন আন্দোলন এর মাধ্যমে তারা স্বাধীনতার রব তুলতে থাকে। ১৯৪০ সালের দিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের ভারতীয়দের সাহায্য দরকার পড়ায় ইংরেজরা ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব বা পরিকল্পনা হলো মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা।
পটভূমি : ওয়াভেল পরিকল্পনা (১৯৪৫) ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতীয় রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলি নিরসনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ১৯৪৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি মন্ত্রিমিশন গঠন করেন। মার্চ মাসে এ মন্ত্রিমিশন ভারতে অগমন করে। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার তিন সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিমিশনের সদস্যরা ছিলেন (১) স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, (২) লর্ড প্যাথিক লরেন্স ও (৩) এ. ভি. আলেকজান্ডার। এ মিশনের প্রধান ছিলেন লর্ড প্যাথিক লরেন্স। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ছিলেন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী এবং এ. ভি. আলেকজান্ডার ছিলেন যৌথ বিভাগের প্রধান। মন্ত্রিমিশন ভারতে স্বাধীনতা প্রদানের পদ্ধতি প্রণয়ন এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন কিন্তু উভয় দলের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি না হওয়ায় মন্ত্রিমিশন তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা পেশ করেন এটাই মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা (Cabinat Mission Plan) নামে খ্যাত। মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ (Main features of the cabinet mission) : ১৯৪৬ সালের মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : (ক) দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব ও (খ) স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব।
ক. দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব: ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলো নিয়ে ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ নামে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। কেন্দ্রের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয় থাকবে।
১. উপর্যুক্ত বিষয় ছাড়া বাদবাকি বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে।
২. ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন ও আইন বিভাগ গঠিত হবে।
৩. ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলো তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হবে। হিন্দুপ্রধান, মুসলিম প্রধান এবং বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হবে ৩ টি গ্রুপ।
৪. প্রত্যেক গ্রুপের এবং গ্রুপের অধীনে প্রদেশগুলো নিজ নিজ সরকার ও সংবিধান রাখতে ।
৫.প্রদেশগুলো পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।
৬. সংবিধান প্রণয়নের পর প্রদেশগুলো যে কোনো গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
৭. ভারতীয় ইউনিয়নের জন্য সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সকল গ্রুপের প্রতিনিধি নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠিত হবে।
৮. তিনটি গ্রুপ বা সেকশনে গণপরিষদকে বিভক্ত করা হবে।
খ. স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব : ১. নতুন সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত গভর্নর জেনারেল এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim government) গঠন করবেন। লোপ পাবে।
২. সংবিধান প্রণয়ন এবং ভারত ইউনিয়ন গঠিত হলে দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর থেকে ব্রিটিশ সরকারের সার্বভৌমত্ব মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণ (Failure of cabinet mission plan) : ১৯৪৬ সালে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ঘোষিত হবার পর গভর্নর জেনারেল ঘোষণা করেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে তারাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করবে। মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার বাধ্য
তামূলক গ্রুপিং ব্যবস্থা, প্রদেশগুলোর নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালের ৬ জুন এ পরিকল্পনা গ্রহণে রাজি হন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বাধ্যতামূলক গ্রুপ ব্যবস্থা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদান করতে অস্বীকার করে
কিন্তু অখণ্ড ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গণপরিষদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু গভর্নর ওয়াভেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন স্থগিত করে। মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারকে ওয়াদা ভঙ্গকারী বলে সমালোচনা করে। ওয়াভেল এর পরের মাসেই কংগ্রেস এর নেতা জওহরলাল নেহেরুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান। এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ (Direct action day) পালনের আহ্বান জানায়। এ দিনে কলকাতায় দাঙ্গায় প্রায় ৫০,০০০ লোক হতাহত হয়। ১৯৪৬ সালের ২৪ আগস্ট কংগ্রেসের নেতা নেহেরুর নেতৃত্বে ২১ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। মুসলিম লীগ উক্ত দিবসকে কালো দিবস ঘোষণা করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সমগ্র উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগদানে অনুরোধ করে। ১৯৪৬ সালের ১৫ অক্টোবর লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যবিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতাগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যোগদান করে। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সম্পর্ক দ্রুত তিক্ত রূপ ধারণ করে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। ফলে মন্ত্রিমিশন ব্যর্থ হয়।