ভূমিকার প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, ভূমিকার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে মানুষকে বিবিধ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে সব মানুষ একই রূপ দায়িত্ব পালন করে না। কেউ অফিসে, কেউ শিল্পকারখানায়, কেউবা কৃষিক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে । এভাবে সমাজে বিভিন্ন মানুষ যে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব বা কর্তব্য সম্পাদন করে তাই ভূমিকা (Role) হিসেবে অভিহিত।
ভূমিকার প্রকারভেদ : সমাজে মানুষের মর্যাদা অনুযায়ী তার ভূমিকা নির্ণীত হয়। মর্যাদা এবং ভূমিকা পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তির ভূমিকা কিরূপ হবে তা নির্ভর করে সমাজে ঐ ব্যক্তির মর্যাদা বা সামাজিক পরিচিতি তথা সামাজিক অবস্থানের উপর। আর এ কারণেই ভূমিকার প্রকারভেদের বিষয়টি চলে আসে। ভূমিকার এ বিবিধ ধরন বা বৈশিষ্ট্যকে অধ্যাপক অগবার্ন ও নিমকফ্ দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
১. আরোপিত ভূমিকা (Ascribed Role) এবং
অর্জিত ভূমিকা (Achieved Role)
২.এ দু’প্রকারের ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. আরোপিত ভূমিকা : যেসব ভূমিকা সাধারণভাবে ব্যক্তিমানুষের উপরে আরোপ করা হয়ে থাকে তাকে আরোপিত ভূমিকা বলে । সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, জন্মগতভাবে বা সামাজিকভাবে তথা সমাজে প্রচলিত ধারা বা প্রথা অনুসারে সমাজের মানুষের উপরে যেসব ভূমিকা আরোপ করা হয় তাকে আরোপিত ভূমিকা বলে। ভারতে সনাতন হিন্দুসমাজে বর্ণবিন্যাস ও জাতিভেদ প্রথার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিকা আরোপের ধারা লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
ক. জন্মগতভাবে : যেসব ভূমিকা জন্মের ভিত্তিতে বা জন্মগতভাবে মানুষের উপর আরোপিত হয় তাকে জন্মগতভাবে আরোপিত ভূমিকা বলে। যেমন- প্রাচীন হিন্দুসমাজে কেউ বৈশ্য বর্ণে জন্মগ্রহণ করলে তার উপর
আরোপিত ভূমিকা হতো ব্যবসায় বাণিজ্য করা। সে ইচ্ছা করলেও রাজ্য শাসনের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারতো না। আবার কেউ মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করলে তার উপর আরোপিত ভূমিকা হতো গৃহের দায়িত্ব পালন। এসব ভূমিকা জন্মগত কারণেই মানুষের উপর আরোপিত হয়।
খ. সামাজিক প্রথা বা সমাজে প্রচলিত ধারা অনুসারে : যেসব ভূমিকা সামাজিক প্রথা অনুসারে ব্যক্তিমানুষের উপরে আরোপিত হয় তাকে সামাজিক প্রথা অনুসারে আরোপিত ভূমিকা বলা হয়। যেমন- ভারতে সনাতন হিন্দুসমাজে বর্ণবিন্যাস বা জাতিভেদ প্রথার ভিত্তিতে ভূমিকা আরোপের বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রাচীন হিন্দুসমাজ চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল। যথা : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল যজন-যাজন, অধ্যাপনা প্রভৃতি, ক্ষত্রিয়দের ভূমিকা ছিল রাজ্য শাসন ও তা রক্ষা করা, বৈশ্যদের কাজ ছিল ব্যবসায় বাণিজ্য করা এবং শূদ্রদের কাজ ছিল পূর্বে উল্লিখিত তিন বর্ণের সেবা করা। এদের প্রত্যেকের ভূমিকা ছিল সামাজিক প্রথা অনুসারে নির্ধারিত। কেউই স্বীয় ভূমিকার বাইরে অন্য কোন ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেত না।
গ. লিঙ্গের ভিত্তিতে আরোপিত ভূমিকা : যেসব ভূমিকা লিঙ্গের ভিত্তিতে অর্থাৎ ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষ এবং স্বামী-স্ত্রীর ভিত্তিতে ব্যক্তিমানুষের উপর আরোপিত হয়ে থাকে তাকে লিঙ্গের ভিত্তিতে আরোপিত ভূমিকা বলা হয়ে থাকে। যেমন- পরিবারে পুরুষদের ভূমিকা আয় করা, পরিবারের ভরণপোষণ করা, পরিবারের কর্তার ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি।
অন্যদিকে, স্ত্রীলোকের ভূমিকা হলো সন্তান লালনপালন করা, গৃহস্থালির কাজকর্ম করা ইত্যাদি। এসব ভূমিকা লিঙ্গের ভিত্তিতে আরোপিত হয়ে থাকে।
ঘ. বয়সের ভিত্তিতে আরোপিত ভূমিকা : কিছু কিছু ভূমিকা আছে যেগুলো বয়সের ভিত্তিতে আরোপিত হয়ে থাকে। সমাজে ছোটদের উপর এক ধরনের ভূমিকা আরোপ করা হয় এবং বড়দের উপর আরেক ধরনের ভূমিকা আরোপ করা হয়। স্বভাবতই বড়দের উপর আরোপিত ভূমিকা তুলনামূলকভাবে ছোটদের চেয়ে ব্যাপক, জটিল এবং বে
শি গুরুত্বপূর্ণ।
২. অর্জিত ভূমিকা : স্বীয় যোগ্যতা, দক্ষতা এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষ যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাকে অর্জিত ভূমিকা বা Achieved role বলে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গুণাবলি ও প্রতিভা এবং অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত গুণাবলির ভিত্তিতে যেসব পদ বা বৃত্তি গ্রহণ করে তা অর্জিত ভূমিকা হিসেবে অভিহিত। এখানে ব্যক্তিগত গুণাবলির অর্থ হলো গুণগত যোগ্যতা, দক্ষতা, বিদ্যা-বুদ্ধি, স্বাভাবিক প্রবণতা, প্রচেষ্টা, শ্রম ইত্যাদি। অর্জিত ভূমিকা পরিবর্তনশীল। এ ভূমিকার উন্নতি যেমন হতে পারে, অবনতিও তেমনি হতে পারে। যথেষ্ট দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সাফল্যের সাথে অর্জিত ভূমিকার দায়দায়িত্ব সম্পাদনে সমর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পদোন্নতি ঘটে। অপরদিকে, দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, দুর্নীতি ইত্যাদির কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তির পদাবনতি ঘটতে পারে। শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ অধিকতর হলে পদচ্যুতিও ঘটতে পারে। কাজেই অর্জিত ভূমিকার উন্নতি অবনতি ব্যক্তির সার্বিক আচরণের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অর্জিত ভূমিকা ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণমান, সার্বিক আচরণ এবং দায়িত্ব পালনের ধরন ও সমাজব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমাজজীবনে ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়, যার উপর সমাজের সফলতা বা বিফলতা, উন্নতি বা অবনতি নির্ভর করে। কিন্তু সমাজে এ ভূমিকা অপরিবর্তনীয় বা একই রূপ নয়। সমাজব্যবস্থা তথা সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুসারে কিছু ভূমিকা নির্দিষ্ট। এগুলো সমাজের নিয়মনীতি অনুসারে পূর্ব হতেই নির্ধারিত। এ ধরনের ভূমিকা আরোপিত ভূমিকা হিসেবে আখ্যায়িত। ভূমিকা যে প্রকারেরই হোক না কেন সমাজের প্রত্যেক সদস্য যদি তার নিজ নিজ ভূমিকা সঠিক ও যথাযথভাবে পালন করে তবেই সমাজের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ও উন্নতি নিশ্চিত হবে।